শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

গণহত্যার দায় মিয়ানমারের

আন্তর্জাতিক গণআদালতে দোষী সাব্যস্ত সু চি ও সেনাবাহিনী, ১৭ সুপারিশ

জহিরুল ইসলাম হিরণ, মালয়েশিয়া থেকে

গণহত্যার দায় মিয়ানমারের

মিয়ানমারে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি সরকার ও তার সেনাবাহিনীকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণআদালত।

গতকাল দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত সাত সদস্যের বিচারক প্যানেল রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যার অন্তত ২০০ সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে এ রায় ঘোষণা করেন। মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ মিলনায়তনে জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণাকালে রায়ের আলোকে আদালত ১৭টি সুপারিশও করেছে। পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের (পিপিটি) সর্বসম্মতিক্রমে দেওয়া এই রায়ে মিয়ানমারের ওপর অবিলম্বে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিয়ানমারের সরকারি পদে থাকা ব্যক্তিদের বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাব বাজেয়াপ্ত, মিয়ানমারের বাইরে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ৩০ পৃষ্ঠার রায়ের বিভিন্ন অংশ ট্রাইব্যুনালের সাতজন বিচারক পর্যায়ক্রমে পাঠ করেন। তবে রায়ের কার্যকর অংশ পাঠ করেন অস্ট্রেলীয় বিচারক জিল এইচ বোয়েরিঙ্গার।

আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্ট্যাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটনও জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, অন্যান্য বৌদ্ধ মিলিশিয়া এবং দেশটির বর্তমান বেসামরিক সরকার অভিযুক্ত। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, তারা মিয়ানমারের সর্বস্তরে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। সাত সদস্যের প্যানেলে ছিলেন— ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও আর্জেন্টিনায় সেন্টার ফর জেনোসাইডের প্রতিষ্ঠাতা দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন, গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী আয়ারল্যান্ডের ডেনিস হেলিডে, ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত-প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা মালয়েশিয়ার জুলাইহা ইসমাইল, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে কাজ করা পিপিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কম্বোডীয় আইনবিদ হেলেন, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির মেকুইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক প্রধান গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার, ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী নুরসিয়াবানি কাতজাসুংকানা, ইরানের মানবাধিকার আইনজীবী সাদি সদর এবং ইতালির সুপ্রিম কোর্ট অব ক্যাসেসনের বর্তমান সলিসিটর জেনারেল নিলও রেসি। পিপলস ট্রাইব্যুনালের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও এই শুনানিতে অংশ নেন। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা তিনি কুয়ালালামপুরে তুলে ধরেন।

ট্রাইব্যুনালে মিয়ানমারে মুসলিম নিপীড়ন বিষয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। পরে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সমাপনী বক্তব্য শেষে বিবাদী পক্ষ বক্তব্য রাখেন। আর বৃহস্পতিবার দিনভর বিচারকমণ্ডলীর সদস্যরা তাদের বক্তব্য পেশ করেন। এ ব্যাপারে পিপিটি মালয়েশীয় শাখার সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি চন্দ্র মোজাফফর বলেছেন, পাঁচ দিনের অধিবেশনে বিচারকরা প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক, বিশেষজ্ঞ সাক্ষীদের মতামত, ভুক্তভোগীদের জবানবন্দি বিচার বিশ্লেষণ করে এ রায় দেন। প্রতীকী বিচার কার্যক্রমের এই রায়কে মিয়ানমার সরকারের অপরাধ চিহ্নিত করার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। আসিয়ান বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় এই পিপলস ট্রাইব্যুনালের তথ্য-প্রমাণ কাজে লাগানো যাবে বলেও তিনি মত দেন।

ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১৭ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে ১. মিয়ানমার সরকার এবং আসিয়ান প্রতিনিধিরা রাখাইনের সব সশস্ত্র গ্রুপকে নিয়ে রাখাইন সীমান্ত বরাবর অঞ্চলের বেসামরিকীকরণ এবং একটি অস্ত্রবিরতির প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন, ২. অং সান সু চির ঘোষিত ‘যাচাইকরণ প্রক্রিয়ায়’ রোহিঙ্গাসহ সব গোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিকত্ব দিতে হবে, ৩. জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থাকে রাখাইনের ঘটনা তদন্তের অনুমতি দিতে হবে, ৪. মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি তার বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করতে হবে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিলসহ ২০০৮ সালের সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে, ৫. মিয়ানমারের পার্লামেন্টে সামরিক প্রতিনিধির কোটা বাতিল করতে হবে, ৬. সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশকে পূর্ণ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে আনতে সংবিধানে নিশ্চয়তা থাকতে হবে, ৭. মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের দায়মুক্তি বন্ধ করে দোষী ব্যক্তিদের বিচার শুরু করতে হবে, ৮. বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন এবং তাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানে একটি স্বাধীন বেসরকারি কমিশন গঠন করতে হবে, ৯. একটি ফেডারেল কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী যে তাদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসন নিজেরাই নিশ্চিত করার সামর্থ্য রাখে, সেটা স্বীকার করতে হবে, ১০. মিয়ানমার ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোকে মানবিক, মানবাধিকার, ধর্মীয় সংগঠন এবং সাংবাদিকদের রাখাইন প্রদেশ, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুসহ কাচিন ও অন্য গোষ্ঠীগুলোর এলাকায় প্রবেশাধিকার দিতে হবে, ১১. উদ্বাস্তু প্রবাহকে নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখার একটি প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু সেটা শুধু ত্রুটিপূর্ণই নয়, এটা ভ্রান্তনীতি অনুসরণে উৎসাহিত করতে পারে। রায়ের এ পর্যায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহ রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী পরিচয়পত্র দেওয়ার আহ্বান জানাই। কারণ, এটা তাদের নির্বিচারে গ্রেফতার হওয়া থেকে সুরক্ষা দেবে, ১২. অভিবাসন সংকট যেটা দেখা দিয়েছে, তার দায়ভার আসিয়ান দেশগুলোকে নিতে হবে। আসিয়ান সনদ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের সীমান্ত খুলে দিতে হবে, ১৩. বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য জাতি যারা রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানিয়েছে, তাদের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা দিতে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের মতো সম্পদশালীদের এগিয়ে আসতে হবে, ১৪. স্বাগত জানানো দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। আবার একই সঙ্গে মানব পাচারকারীদের বিপদ থেকে বাঁচতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমকে উৎসাহিত করতে হবে, ১৫. মিয়ানমারের সরকারের ওপর আশু অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে, ১৬. মিয়ানমারের সরকারের কর্মকর্তাদের ওপর টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে, ১৭. এরকম ঘটনার কারণ সম্পর্কে যা বিশ্বের জানা ছিল না, তা জানতে এবং সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বেসরকারি কমিশন গঠন করতে হবে। এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুনানিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের একটি প্যানেল অংশ নেয়। গণআদালতের এ রায় জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও গোষ্ঠীর কাছে পাঠানো হবে। প্রসঙ্গত, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ১৯৭৯ সালে ইতালির বোলোনিয়ায় যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক গণআদালত পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে এর আন্তর্জাতিক সদস্য সংখ্যা ৬৬। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মানবাধিকার ও গণহত্যা সংক্রান্ত ৪৩টি প্রতীকী বিচারের আয়োজন করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর