শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মজুরি বৈষম্যে স্কুলে সন্তান পাঠাচ্ছে না শ্রমিকরা

যুক্তরাজ্যের তিন বড় ক্রেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে গার্মেন্ট কর্মীদের কষ্টের চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

মজুরি বৈষম্যে স্কুলে সন্তান পাঠাচ্ছে না শ্রমিকরা

মজুরি বৈষম্যের ফলে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা অনেকেই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। অর্থাভাবে অনেকেই আবার নিজের শিশু সন্তানকে গ্রামে তার আত্মীয়ের কাছে রেখে আসছেন। অভিযোগ উঠেছে যে, যুক্তরাজ্য ও ব্রিটেনের বড় পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান- টেসকো, আলদি ও আসদা কম দাম দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক তৈরি করিয়ে নিচ্ছে। এসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করছেন যেসব শ্রমিক তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। তারা শিকার হচ্ছেন মজুরি বৈষম্যের। বাংলাদেশের এই শ্রমিকরা ব্রিটিশ শিশুদের জন্য স্কুলের ইউনিফর্ম তৈরি করে দেন অথচ নিজেদের সন্তানদের তারা স্কুলে পাঠাতে পারেন না। শ্রমিক মা-বাবারা নিজেরা কোনোরকম কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি একরুমের বাসা ভাড়া করে থাকলেও কম মজুরির কারণে খরচ কমাতে সন্তানদের নিজদের থেকে দূরে আত্মীয়ের কাছে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। বছরে মাত্র দুই-তিনবার সন্তানের কাছে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, মির্জাপুরের ‘নাজ’ নামের একটি পোশাক কারখানায় যুক্তরাজ্যের অন্যতম বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আলদির দুটি পলো টি-শার্ট তৈরিতে ব্যয় হয় ২১২ টাকা। আর যে বাংলাদেশি শ্রমিকরা এই টি-শার্ট তৈরি করেন মাস শেষে তাদের ন্যূনতম মজুরি হিসেবে দেওয়া হয় পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। শ্রমিকরা জানান, তাদের সপ্তাহে নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা ৬০ ঘণ্টার বাইরেও অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। কখনো কখনো তা ৭৪ ঘণ্টাও হয়ে যায়। বিষয়টি আলদি কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা সেই কারখানার ব্যাপারে খোঁজ নেবে বলে জানায়। নাজ গার্মেন্টের একজন কর্মকর্তা জানান, সরকারের নির্ধারিত মজুরি মেনেই তারা শ্রমিকদের মজুরি দেন। এ ছাড়া প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পায়। এই কারখানাটিতেই আরেক বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান টেসকোরও পোশাক তৈরি করা হয়। এখানে কর্মরত এক নারী শ্রমিক জানান, টাকার অভাবে তার ১০ বছর বয়সী মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি পোশাকের দাম সামান্য বাড়িয়ে দেয় তাহলে শ্রমিক ও তার সন্তানের জীবনমান আরেকটু ভালো হবে। আবার কম মজুরির জন্য অনেক শ্রমিকই একটু বেশি আয়ের জন্য ওভার ডিউটি করেন। বড় কোনো দুর্ঘটনা বা চিকিৎসার খরচ মেটাতে অনেকেই টাকা ঋণ নেন। চলতি বছরের শুরুতে পোশাক শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি দাবি নিয়ে আন্দোলনে গেলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। আর শ্রমিক নেতাদেরও বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে অর্ডারের সময়সীমার কথা মাথায় রেখেই পোশাক কারখানার মালিকরাও পোশাক উৎপাদনের খরচ কমাতে শ্রমিকদের বেতন কম দেন। গাজীপুরের ডিআইআরডি কম্পোজিট টেক্সটাইল কারখানায় অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান টেসকোর জন্য স্কুলের শীতের পোশাক তৈরি করা হয়। যুক্তরাজ্যে এই শীত পোশাক প্রতিটি সাড়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয় আর এই কারখানারই একজন মেশিন অপারেটর শাহীন (৩০) মাসে বেতন পান মাত্র সাত হাজার টাকা। আর এই টাকায় তার জীবনযাপন করা বেশ কঠিন। এজন্য সন্তানকে নিজের কাছে না রেখে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন শাহীন। আবার সন্তানকে গ্রামে দেখতে যেতে চাইলে খরচ বেশি হয় বলে খুব বেশি সন্তানের কাছে যাওয়ার সুযোগও পান না তিনি। এ ব্যাপারে টেসকো কর্তৃপক্ষ জানায়, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে কারখানা কর্তৃপক্ষ জানান, তারা অন্য যে কোনো কারখানা থেকে শ্রমিকদের বেশি বেতন দেন। মির্জাপুরের ব্যাবিলন কারখানা যুক্তরাজ্যের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আসদার জন্য স্কুল শার্ট তৈরি করে। এই কারখানার নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হাসান বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির সেবার কথা উল্লেখ করলেও এই কারখানার শ্রমিকদেরও বেছে নিতে হয়েছে কষ্টের জীবন। এখানে রিনা নামের এক নারী শ্রমিক হেলপার হিসেবে সাড়ে ৫ হাজার টাকা বেতন পান। স্বামী নিয়ে কারখানা থেকে কিছুটা দূরে এক রুমের ঘর ভাড়া করে থাকলেও তার সাত বছর বয়সী কন্যাকে আত্মীয়দের কাছে রেখে এসেছেন। আর যাতায়াত খরচ ও দূরত্বের জন্য প্রতি বছর সর্বোচ্চ দুইবার কন্যাকে দেখার সুযোগ পান এই শ্রমিক। আসদার মুখপাত্র শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হচ্ছে কিনা সেটি পর্যবেক্ষণ করার কথা বললেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। 

তবে হাসান জানান, যুক্তরাজ্যের ক্রেতাদের সঙ্গে পোশাকের মূল্য নিয়ে দর কষাকষি করা সহজ নয়। কারণ আমরা অর্ডার না নিলে অন্য কেউ সেই অর্ডার ঠিকই নিয়ে নেবে। ব্যবসার খাতিরে আমরা বিষয়টি মেনে নিচ্ছি।

সর্বশেষ খবর