রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ত্রাণের দায়িত্বে সেনাবাহিনী

শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা, বাদ যাবে না কোনো শরণার্থী, উখিয়া ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) ও টেকনাফ ঘুরে

ত্রাণের দায়িত্বে সেনাবাহিনী

উখিয়া ডিগ্রি কলেজ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বিতরণের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। ত্রাণের অপেক্ষায় সময় কাটছে রোহিঙ্গাদের —রোহেত রাজীব

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণকাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অবশেষে গ্রহণ করল সেনাবাহিনী। বিক্ষিপ্তভাবে ত্রাণ বিতরণ হয়েছিল বেশ কয়েক দিন। এতে সড়কে যেমন যানজটের সৃষ্টি হয়, তেমনই শরণার্থীদের বড় একটি অংশই ছিল ত্রাণবঞ্চিত। তা ছাড়া ত্রাণ দেওয়ার নামে অনেকেই নানাভাবে শোডাউনের চেষ্টা করেন। রোহিঙ্গা পল্লীগুলোয় ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ির পাশাপাশি একটি দালাল শ্রেণিরও উৎপাত শুরু হয়। রাস্তায় বেড়ে যায় দুর্ঘটনা। সবকিছু বিবেচনায় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকাল সকালে ত্রাণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নেয় সেনাবাহিনী। এদিকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৫৫ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে ত্রাণসামগ্রী জমা দিয়ে যায়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উখিয়া ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে দুপুর ১২টায় সেনা সদস্যরা সরকারি-বেসরকারি সব ত্রাণ বুঝে নিচ্ছেন। সেখানে তিনটি নিবন্ধন বুথ তৈরি করে ১০ জন সেনা সদস্য ত্রাণদাতাদের কাছ থেকে সব মালামাল গ্রহণ করছেন। তালিকা তৈরি করে ‘ত্রাণসামগ্রী গৃহীত’ মর্মে দাতাদের রসিদ দেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পাসসংলগ্ন একটি কক্ষে ত্রাণ জমা রাখা হচ্ছে। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থাগুলোর ত্রাণ বিতরণে কোনো বিধিনিষেধ নেই সেনাবাহিনীর। সংস্থাগুলো নিজস্ব তত্ত্বাবধানেই ত্রাণ বিতরণ করছে। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে কথা হয় কয়েকজন ত্রাণদাতার সঙ্গে। তারা অনেকটা অনুনয়-বিনয় প্রকাশ করেও নিজস্ব উদ্যোগে ত্রাণ দিতে সেবাবাহিনীর সম্মতি আদায় করতে পারেনি। ফলে নিয়ন্ত্রণকক্ষে ত্রাণ নিবন্ধন করে তাদের ফিরে যেতে হয়। অনেকেই আবার এই শৃঙ্খলাবোধের প্রশংসা করে সেনাবাহিনীর হাতে ত্রাণ দিয়ে হাসিমুখে ফিরে যান। তারা বলেন, ‘এবার ত্রাণসামগ্রী সঠিকভাবে বণ্টন হবে।’

সেখানে দায়িত্বরত মেজর রাশেদ আখতার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সরকারি-বেসরকারি সব ত্রাণ জমা করছি। এগুলো সুশৃঙ্খলভাবে বণ্টন করা হবে। কোনো শরণার্থীই ত্রাণসহায়তা থেকে বাদ যাবে না। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর ত্রাণ আমরা নিচ্ছি না। তারা নিজেদের মতো করেই ত্রাণ বিতরণ করছে।’

জানা যায়, দেশের বিভিন্ন ডিভিশন থেকে অন্তত ৫ হাজার সেনা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে নিয়োজিত হচ্ছেন। এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন লে. কর্নেল মঈন। উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা বেশকিছু ত্রাণবাহী ট্রাক ও মিনিট্রাক দেখা যায়। সেখানে ত্রাণসামগ্রী রেখে তারা আবার কক্সবাজার লিঙ্ক রোড দিয়ে ফিরে গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের উনছিপ্রাং এলাকায় সেনাবাহিনী ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি ছাউনি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানে গতকাল বেশ কিছু সেনা সদস্য ও তাদের গাড়িবহর লক্ষ্য করা যায়। সেনাবাহিনীর একাধিক সদস্য জানান, ‘আমরা এই অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করে বেশ কিছু দিন থাকার জন্য একটি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ক্যাম্পের সামনেই রোহিঙ্গাদের সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে।’ একইভাবে বান্দরবানের বড় ছনখোলা, তুমব্রু, আশারতলি, উখিয়ার থাইংখালী, পালংখালী, বালুখালী ও কুতুপালং এলাকায়ও অস্থায়ীভাবে সেনা ক্যাম্প স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বালুখালী ও কুতুপালংয়ে কিছু রান্না করা খাবার ও কিছু শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। অবশ্য সেখানে রোহিঙ্গারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তবে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে কিছু এলাকায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়।

একাধিক সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আনা ত্রাণকে তারা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করছেন। কেউ কেউ নগদ অর্থও সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করছে। দাতাদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে, তাদের প্রতিটি ত্রাণই সুষমভাবে শরণার্থীদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। ত্রাণ থেকে কোনো রোহিঙ্গাই বাদ যাবে না। বরং এত দিন বিক্ষিপ্তভাবে যে ত্রাণ দেওয়া হয়েছিল, তাতে অনেক নারী ও শিশু বঞ্চিত হয়েছে। এখন সুষ্ঠুভাবে সবার তাঁবুতেই ত্রাণ পৌঁছে যাবে। পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। একজন রোহিঙ্গাও না খেয়ে থাকবে না। তবে যে রোহিঙ্গারা যত দ্রুত নিবন্ধিত হবে, তারাই সর্বাগ্রে ত্রাণ পাবে।

জানা যায়, উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। এদের জন্য কুতুপালং ও বালুখালীতে সরকার ২ হাজার একর জমিও বরাদ্দ করেছে। কিন্তু সেখানে একটি ক্ষুদ্র অংশ গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বেশির ভাগই বিভিন্ন সরকারি পাহাড় ও বনভূমিতে নিজেদের মতো করে আশ্রয়শিবির বানিয়েছে। তাদের এক স্থানে নিয়ে আসাও বড় চ্যালেঞ্জ। আপাতত সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে গিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা দেবে। তবে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের একটি প্লাটফরমে নিয়ে আসা হবে।

এদিকে গতকাল সকাল থেকে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিক্ষিপ্তভাবে ত্রাণ বিতরণ করে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভীর নেতৃত্বে দলের একটি প্রতিনিধি দল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কুতুপালং-২ নম্বর সেনা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ করে। এ সময় রিজভী আহমেদের সঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, স্বেচ্ছাসেবাবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, মত্স্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক লুত্ফর রহমান কাজল, মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম ইউসুফ, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ভিপি হারুন অর রশীদ, কক্সবাজার জেলা সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামীম আরা স্বপ্না, চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, শিবচর উপজেলা বিএনপি সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে রিজভীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল বালুখালীতে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) ক্যাম্পে গিয়ে ওষুধ বিতরণ করে।

গড়ে ১০ জনের মৃত্যু : রোগশোকে ভুগে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোয় প্রতিদিন ৮-১০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। রোদবৃষ্টির পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকেই জ্বর-কাশি- নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। গতকালও পালংখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মহিলাসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে মারা যান মিয়ানমারের বুসিদং চৌপাড়া থেকে ১৫ দিন আগে আসা আনোয়ারা বেগম (৫৫)। তার স্বামী আমির আহমদ জানান, দীর্ঘ পথ হেঁটে আসায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখানকার মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিয়েও কাজ হয়নি। অবশেষে গতকাল সকালে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সকালে মাছ দিয়ে ভাত খাবেন বলে জানালে স্বামী আমির আহমদ মাছ কিনে তাঁবুতে ফেরার কিছুক্ষণ পর আনোয়ারা বেগম মারা যান বলে জানান। এ ছাড়া গতকাল একই ক্যাম্পে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৫ বছর বয়সী বিধবা জমিলা খাতুন। এর আগে শুক্রবার অসুস্থ হয়ে মারা যান বুসিদংয়ের রংপাড়া থেকে আসা ৭৫ বছরের বৃদ্ধ এক শরণার্থী। তার নাম-পরিচয় জানা না গেলেও ক্যাম্পের প্রতিবেশীরা জানান, তাকে সবাই মৌলবি শাকের আহমদের পিতা বলে চিনতেন। এ রকম প্রায় প্রতিটি ক্যাম্পে রোগাক্রান্ত শরণার্থীর মৃত্যু সংবাদ শোনা য়ায়। মারা গেলে এই শরণার্থীদের নির্জন পাহাড়েই দাফন করা হয়।

সর্বশেষ খবর