রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ২৪

খুনের আগেই খুনির জিডি

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনের আগেই খুনির জিডি

কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেয় লাবণী। পুলিশ দরজার সামনে! আঁতকে ওঠেন। সাতসকালে পুলিশ কেন? কেউ কিছু বুঝে ফেলেছে নাকি! চুপ মেরে গেলেন লাবণী। ম্যাডাম, আমি মিরপুর থানা থেকে এসেছি। পুলিশ নীরবতা ভাঙে। লাবণী খুব আশ্চর্য হয়ে পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলল, ও হ্যাঁ, বলুন। আপনার নাম কি লাবণী? পুলিশের এমন প্রশ্নে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয় লাবণীর। সে জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, কেন বলুন তো? না, আমরা এক জিডির তদন্ত করতে এসেছি। আপনি যদি লাবণী হয়ে থাকেন, তাহলে এটি আপনার জিডি। আপনিই তো আপনার স্বামী সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে জিডি করেছেন। এ কথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন লাবণী। তিনি বলেন, আচ্ছা, তাই বলুন। আমার নাম লাবণী। আসুন, ভিতরে আসুন। বসুন। পুলিশের এসআই ড্রইং রুমের একটি সোফায় বসেন। চারদিক লক্ষ্য করে নেন। লাবণী তার উল্টো পাশের সোফায় বসে কথা শুরু করলেন। দেখুন না, আমিতো কেমন ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। হঠাৎ পুলিশ কেন এলো, কী বিষয়ে এলো? আপনাকে দেখে অবাক আমি। শুনে পুলিশ লাবণীর দিকে খুব সূক্ষ্মভাবে তাকায়। বলে, কেন আপনি যে আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন, তা ভুলে গেছেন। সেটার তদন্ত করতে এসেছি। আপনার স্বামীকেও প্রয়োজন। স্বামীর কথা শুনেই চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায় লাবণীর। এই বিষয়টি পুলিশের চোখ এড়ায়নি। পুলিশের এই কর্মকর্তা লাবণীর কাছে এক গ্লাস পানি চান। লাবণী পানি আনতে ভিতরে চলে গেলেন।

এই সুযোগে পুলিশের এই কর্মকর্তাটি আশপাশ ভালো করে দেখে নেন। বাসায় কি আর কেউ নেই? তাহলে তারা যে সংবাদ পেয়েছিল, সেটা কি সঠিক? তার স্বামী নিখোঁজ বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে স্ত্রীর বিরুদ্ধে তা কতটুকু সত্য হতে পারে! এমন নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে পুলিশ কর্মকর্তাটির। ছোট ছোট পায়ে খুব সাবধানে তিনি ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে কড়িডোরের দিকে যান। ফ্লোরের এক কোনে রক্ত লাগানো কাপড় দেখতে পান। সেটি দ্রুত তুলে নেন পুলিশের কর্মকর্তাটি। কাপড়টি রক্তে ভেজা ছিল। বেশি সময় হয়নি রক্ত লেগেছে। বুঝতে পারেন তিনি। সেটি নিয়েই তিনি ড্রইং রুমে চলে আসেন। নাস্তা পানি নিয়ে চলে এসেছেন লাবণী। পুলিশ কর্মকর্তাটির সরাসরি প্রশ্ন, আপনার স্বামী সালাউদ্দিনকে খবর দিন। লাবণী বলে, ওতো বাসায় নেই। কাল রাতে বেরিয়েছে। ফেরেনি আর। আপনার আমাকে কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। তার আগে নাস্তা করে নিন। কিন্তু সেই রক্তের দাগ দেখে পুলিশ কর্মকর্তাটির আর ভালো লাগছে না। লাবণীর জিডি তদন্ত করতে যেয়ে উল্টো তাকেই সন্দেহ করছে পুলিশ। ভাবছে, সালাউদ্দিনের পরিবার যে অভিযোগ করেছে, তা কি সঠিক? লাবণীকে প্রশ্ন করতে গেলেই উল্টো প্রশ্ন রাখেন পুলিশকে। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি লাবণী। বিশেষ করে পুলিশ যখন তার সামনে রক্তে ভেজা কাপড়ের টুকরাটি রাখেন, তখন আর কিছু বুঝতে দেরি হয়নি লাবণীর। ধরা তাকে দিতেই হবে। পুলিশের নানা প্রশ্নের জালে স্বীকার করতে বাধ্য হয়। পুলিশ ওয়ারড্রোব থেকে উদ্ধার করে সালাউদ্দিনের লাশ। স্বামী হত্যার দায়ে গ্রেফতার হয় লাবণী। পুলিশ জানিয়েছে, পরকীয়ার সন্দেহে স্বামীকে হত্যা করেছে লাবণী।

ঘটনাটি রাজধানীর মিরপুরের কল্যাণপুরের। ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর সালাউদ্দিনের লাশ পুলিশ উদ্ধার করে ওয়ারড্রোব থেকে। স্ত্রী লাবণী বঁটি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। গুম করতে লাশটি লেপ মুড়ি দিয়ে ওয়ারড্রোবের ভিতরে লুকিয়ে রাখে। লাবণী কারাগারে।

ঘটনার নেপথ্যে : প্রেম করে দুটি বিয়ে করেছিলেন সালাহউদ্দিন। তবে প্রথম স্ত্রীর অজান্তে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন তিনি। এই বিয়ের কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তার প্রথম স্ত্রী লাবণী। হত্যার আগে স্বামীর বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন লাবণী। হত্যার পর তার লাশটি লেপ ও চাদর দিয়ে মুড়ে ওয়ারড্রোবের ভিতরে রেখে দেওয়া হয়। লাশটি গুম করার পরিকল্পনা ছিল তার। তার আগেই নিজের করা জিডির তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ফাঁস হয় এই ভয়ঙ্কর খুনের ঘটনা। তাত্ক্ষণিকভাবে আটক করা হয় লাবণীকে। পুলিশ জানায়, খুন করার আগে লাবণী তার স্বামীর বিরুদ্ধেই জিডি করে নেন।

জানা গেছে, দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি নিয়ে লাবণীর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ চলছিল। একপর্যায়ে সালাউদ্দিন বাসা ছেড়ে দ্বিতীয় স্ত্রী মাহমুদা আক্তারের বাসায় চলে যান। পরে তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ার আটপাড়ায় যান তিনি। কিন্তু সালাউদ্দিনের মা পারভিন আক্তার তাকে নিয়ে প্রথম স্ত্রীর বাসায় যান। সালাউদ্দিনকে দিয়ে আসেন। দুই পরিবারের গার্ডিয়ানদের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে তাদের মিলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু লাবণী সবার সামনেই সালাউদ্দিনকে মারধর করে। সালাউদ্দিন এ সময় তার মাকে জানায়, মা আমাকে এখানে রেখে যেও না। তোমাদের সামনেই আমাকে মারল। তোমরা চলে যাওয়ার পর আমাকে মেরেই ফেলবে। এ সময় পরদিন আবারও বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেই রাতেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটে লাবণী।

সালাউদ্দিনের মা, বোন ও ভগ্নিপতি চলে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে আবারও ঝগড়া হয়। এ সময় সালাউদ্দিন কিছু সময়ের জন্য বাইরে যান। আবারও বাসায় ফিরে আসেন তিনি। লাবণী এ সময় থানায় গিয়ে তার স্বামী নিখোঁজ বলে জিডি করেন। সে বাসায় ফিরে এসে সালাউদ্দিনের সঙ্গে আবারও ঝগড়া বাধায়। রাতে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে সালাউদ্দিন। এরপর বঁটি দিয়ে ঘুমন্ত সালাউদ্দিনকে কোপাতে থাকে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় সালাউদ্দিন। সকালে লাশটি গুম করতে বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সালাউদ্দিনের লাশ লেপ দিয়ে মুড়িয়ে ওয়ারড্রোবে ভরে রাখে লাবণী। লাশের মাথা নিচে ও পা ওপরের দিকে করে ভাঁজ করা ছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর