সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ২৫

মাফিয়াদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা

মির্জা মেহেদী তমাল

মাফিয়াদের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা

শরীরটা ভালো লাগছিল না সার্জেন্ট আলাউদ্দিনের। একটু আগেভাগেই আজ বাসায় ফিরছেন। রাত ৮টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দর ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার (সিইউএফএল) ঘাটের পাশের খেয়াঘাটে এসে দাঁড়ান তিনি। ঘাট তখন শূন্য। কোনো ট্রলার নেই। সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে দেখে পূর্বপরিচিত দীন মোহাম্মদ সামনে আসে। নদী পারাপারের জন্য তিনি আলাউদ্দিনকে নৌকা ঠিক করে দেন। সার্জেন্ট আলাউদ্দিন সেই নৌকায় চড়ে নদী পার হন। নৌকা থেকে নামতেই ফোন বেজে ওঠে তার। ফোনে কোনো ইনফরমেশন পেয়েই তিনি থেমে যান। খবর দেন কয়লার ডিপো ফাঁড়ির সার্জেন্ট হেলাল উদ্দীনকে। তারা সেই নৌকা দিয়েই ফিরে যান সেই খেয়াঘাটে। যেখান থেকে আলাউদ্দিন নৌকায় চড়েছিলেন। সিইউএফএল ঘাটে দুটি বড় ট্রলার ভেড়ানো। শ্রমিকরা কাঠের বাক্স নামাচ্ছেন। এটা দেখে আলাউদ্দিন হতবাক। ঘণ্টাখানেক আগেও তো কোনো ট্রলার ছিল না! ভাবছেন তিনি। দুই সার্জেন্ট ধীরে ধীরে এগিয়ে যান ট্রলারের সামনে। ‘এগুলো কার মাল’— শ্রমিকদের প্রশ্ন রাখেন আলাউদ্দিন। শ্রমিকরা জানান, সামনে মালিক আছেন। তাদের জিজ্ঞাসা করেন। এ কথা বলেই তারা দ্রুত মাল নামাতে শুরু করেন। দুই সার্জেন্টের সামনে দুই ব্যক্তি এসে কথা বলা শুরু করেন। একজন নিজেকে হাফিজ পরিচয় দেন। তিনি আবার আবুল হোসেন নামে আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মাল খালাস নিয়ে পুলিশের এই দুই সার্জেন্টের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে হাফিজ তার হাতের ফোন সার্জেন্ট আলাউদ্দিনকে দিয়ে বলেন, ‘তোর বাপের সঙ্গে কথা বল, ডিজিএফআইয়ের বড় অফিসার লাইনে আছেন।’ কিন্তু সার্জেন্ট আলাউদ্দিন ওই ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি পাল্টা বলেন, ‘আমি এবার তোমার বাপকে খবর দিচ্ছি। দেখি তোমাকে কে বাঁচায়?’

এরপর ধীরে ধীরে আসতে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফাঁস হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনাটি। পুলিশের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ক্ষমতার দাপট দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়ে অস্ত্র পাচারকারীরা। চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার ঘাটে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে আটক হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র। যা ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা বলে পরিচিত। দুই সার্জেন্টসহ তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে অস্ত্র আটকের এমন নাটকীয় ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে। তদন্তে বেরিয়ে আসে অস্ত্রগুলো ছিল ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ উলফার। অস্ত্র মাফিয়াদের পরিকল্পনা ছিল ভয়ঙ্কর। তারা বাংলাদেশকে অস্ত্র চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু দুই সার্জেন্টের সাহসিকতায় তা নস্যাৎ হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। এ ছাড়া অস্ত্র আটক মামলার দুটি ধারায় এই ১৪ জনকে যাবজ্জীবন ও সাত বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ফাঁসির পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে পাঁচ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। রায় ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান। যদিও পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধ মামলায় নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

সেই রাতে দুই সার্জেন্ট ট্রলার দুটিতে কী হচ্ছে, তা দেখতে যান। দুই সার্জেন্ট ঘাটে গিয়ে মালিককে খোঁজাখুঁজি শুরু করলে হাফিজ ও আবুল হোসেন (একজন শীর্ষস্থানীয় উলফা নেতা) জানান, তারাই মালের মালিক। কোনো ভণিতা না করেই তারা স্পষ্ট জানান, ‘ট্রলার দুটিতে অস্ত্রশস্ত্র আছে। প্রশাসনের সবাই বিষয়টি জানে।’

একপর্যায়ে পুলিশের দুই সার্জেন্টের সঙ্গে আবুল হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাফিজ বলেন, ‘উনি উলফার নেতা, অস্ত্র তাদেরই।’ এসব অস্ত্রের কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কি না, তা পুলিশের দুই কর্মকর্তা জানতে চাইলে খেপে যান হাফিজ। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘কিসের কাগজ, এই অস্ত্র আসার খবর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সবার জানা আছে, এগুলো নামাতে বাধা দিলে আপনার ক্ষতি হবে।’

জানা গেছে, পুলিশ ও অস্ত্র খালাসকারীদের মধ্যে এভাবে তর্ক শুরু হলে ঘাটের শ্রমিকরা একে একে সরে পড়তে থাকেন। ঘাট শ্রমিকদের বলা হয়েছিল, পুলিশের বাধা তো দূরের কথা প্রয়োজনে কোস্টগার্ড এসে এগুলো খালাসে সাহায্য করবে। একপর্যায়ে অস্ত্র খালাসের কাজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে হাবিলদার গোলাম রসুলের নেতৃত্বে বন্দর ফাঁড়ির সব সদস্য, কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান, ঘাটের আনসারসহ আরও অনেকে ঘাটে এসে জড়ো হন। নিজেদের শক্তি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে তখন দুই সার্জেন্ট অস্ত্র খালাসকারীদের সঙ্গে দরকষাকষির চেষ্টা চালান। কিন্তু হাফিজ টাকা দিয়ে সমঝোতার চেষ্টার পরিবর্তে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথা বলে পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এ সময় তিনি ফোনে ক্রমাগত বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন।

এরপর হেলালের সঙ্গে পরামর্শ করে আলাউদ্দিন ডিসি- পোর্টকে মুঠোফোনে অস্ত্র খালাসের বিষয়টি জানান। একই সঙ্গে তিনি কয়লার ডিপোর সার্জেন্ট হেলালসহ আশপাশের সব ফাঁড়ি থেকে পুলিশ পাঠানোর আবেদন জানান। ডিসি- পোর্ট আবদুল্লাহ হেল বাকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তাকে আশ্বস্ত করেন। এরপর ডিসি-পোর্ট আশপাশের সবাইকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার বার্তা দিয়ে নিজেও আসছেন বলে জানান। এ সময় সেখানে উপস্থিত পুলিশের সদস্যরা তাদের পরিচিত অন্যান্য পুলিশ, বিডিআর, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যের মুঠোফোনে খবর দেন। খালাসকারীরা যাতে কোনোভাবেই পার পেয়ে যেতে না পারে, সে জন্য এটা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না বলে সার্জেন্ট আলাউদ্দিন জানান।  জানা গেছে, এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে শুরু করেন। রাতেই বিষয়টি এমনভাবে জানাজানি হয়ে যায় যে, তখন আর কোনোভাবেই তা চেপে যাওয়ার কিংবা অস্ত্রবোঝাই ট্রাকগুলো ও ট্রলার দুটি ছেড়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ কারণে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসন অনেকটা বাধ্য হয় বলে জানা যায়।

এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ। অনেকেই ভেবেছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাহস ও সততার জন্য পুরস্কৃত হবেন সেই দুই সার্জেন্ট। কিন্তু পুরস্কৃত হননি তারা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের রোষানলে পড়েন। খড়গ নেমে আসে সাহসী এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার ওপর। চাকরি হারান। তাদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। মিথ্যা অস্ত্র মামলার আসামি হয়ে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ২৭ মাস। এর আগে এক বছর পালিয়ে বেড়িয়েছেন ফেরার হয়ে। মামলা চালাতে গিয়ে ভিটেবাড়ি বিক্রি করতে হয়েছে। সমাজে হয়েছেন ধিকৃত। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের কাটাতে হয়েছে মানবেতর জীবন। ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারের নায়ক এই দুই সার্জেন্ট হলেও তাদের জীবন হয়েছে তছনছ। তবে এক সময় তাদের জীবন আবারও ফিরে পায় আওয়ামী লীগ সরকার আমলে। হেলাল আর আলাউদ্দিনের এই সাহসিকতার ঘটনাটি স্থান পেয়েছে নতুন সার্জেন্টদের পাঠ্যসূচিতে। তারা পেয়েছেন পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কার।

সর্বশেষ খবর