শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
জাতিসংঘ মহাসচিব বললেন

রাখাইনে মানবিক বিপর্যয়, সেনা অভিযান দ্রুত বন্ধ করুন

শাবান মাহমুদ ও রুহুল আমিন রাসেল, নিউইয়র্ক থেকে

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদে তাদের নিজ গ্রামে ফিরিয়ে নিতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, রাখাইনে সেনা অভিযান বন্ধ করতে হবে। শরণার্থী পরিস্থিতি সংকটের দিকে যাচ্ছে। সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। মানবিক সহায়তার সুযোগ দিতে হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বৈঠকে উপস্থাপন করেন। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এই বৈঠক হয়। নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। ওই বৈঠকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই মিয়ানমারে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরেন। তবে বৈঠকে উপস্থিত মিয়ানমার প্রতিনিধি সে অভিযোগ অস্বীকার করেন। আর বরাবরের মতোই চীন ও রাশিয়া আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর কথা বলেন। তবে বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিক্কি হেলি রাখাইনের পরিস্থিতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার আহ্বান জানান। নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলা মানবিক বিপর্যয়ের নিন্দা জানিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশের নিশ্চয়তা চান। তার মতে, মিয়ানমারে সহিংসতা বর্তমানে বিশ্বের দ্রুততম শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এটা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় নিয়ে গেছে।

অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে সেখানকার আরও আড়াই লাখ মানুষের গৃহহারা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা নারী, পুরুষ ও শিশুদের কাছ থেকে ভয়াবহ বর্ণনা শুনেছে বিশ্ববাসী। সেখানে সহিংসতা এবং মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হচ্ছে। মানুষকে গুলি করা হচ্ছে, মাটিতে পুঁতে রাখা বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে ও  যৌন সহিংসতা চলছে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বরের পর তৃতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় নিরাপত্তা পরিষদে। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের কাছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আশা করেছে বাংলাদেশ। তবে এই ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবের দেখা এখনো মেলেনি।

জড়িত সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার দাবি যুক্তরাষ্ট্রের : নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মিয়ানমারের কাছে সব দেশকে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে জাতি নিধনে যেসব নেতা, বিশেষ করে সামরিক নেতা জড়িত তাদের শাস্তিও দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলি নিরাপত্তা পরিষদের ওই অধিবেশনে এসব দাবি উত্থাপন করেন। এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতাকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করল। পাশাপাশি শাস্তি দাবি করল সেনা কর্মকর্তাদের। নিক্কি হেলি বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নৃশংসতা চালাচ্ছে। তারা জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিধন অভিযান চালাচ্ছে। এ অবস্থায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাতে আমাদের ভীত হওয়া চলবে না। নিক্কি হেলি জাতি নিধনের এই  খেলায় জড়িত নেতাদের তাদের কমান্ডের দায়িত্ব থেকে অবিলম্বে অব্যাহতি দাবি করে এই অপরাধের জন্য বিচার দাবি করেছেন।

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গ্রাম জ্বালাচ্ছে বলল রাশিয়া : রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ও ব্যাপকসংখ্যক মানুষের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার কারণে মিয়ানমার সরকারের ওপর অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হলে তাতে মিয়ানমার ও এর আশপাশের পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজিত করবে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেজিয়া। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এই সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক উপায় ও আলোচনার  কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। বলেন, আলোচনা হতে হবে মিয়ানমারের সব জাতি ও ধর্মের প্রতিনিধিদের মধ্যে। একই সঙ্গে তিনি সব পক্ষের তরফ থেকে সহিংসতা বন্ধের ওপর গুরুত্ব দেন। এ সময় তিনি মিয়ানমার সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, রাশিয়া যেসব তথ্য পাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিরা সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলো থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পালিয়ে বাংলাদেশে যেতে বাধ্য করছে। তিনি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘সন্ত্রাসীরাই’ গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

মিয়ানমার সরকারকে সমর্থনের কথা জানাল চীন : বৈঠকে চীনের উপ-রাষ্ট্রদূত উয়াউ হাইতাও মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, যেসব রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে তাদের সমস্যা দ্রুত সময়ে সমাধান হওয়ার মতো নয়। এ সময় তিনি মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। বলেন, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন করে চীন। তিনি বলেন, এই সংকট সমাধানে সব পক্ষকেই গঠনমূলকভাবে কাজ করতে হবে, উত্তেজনা নিরসন করতে হবে, ধাপে ধাপে মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। তিনি আশা করেন, শিগগিরই সেখানে শৃঙ্খলা ফিরবে। সাধারণ মানুষের ওপর আর সম্ভবত ক্ষতিকর কোনো কিছু ঘটবে না। সমাজে ফিরবে স্থিতিশীলতা।

দায় অস্বীকার মিয়ানমারের : রাখাইন সহিংসতায় নিজেদের দায়  বেমালুম এড়িয়ে গেছেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইউ থাউং তুন। তিনি নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, রাখাইন সংকট ধর্মের ভিত্তিতে নয়। এ সংকটের মূলে রয়েছে সন্ত্রাস। তাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তার দেশের বিরুদ্ধে যেন কোনো পদক্ষেপ না নেয় এমন আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, জাতিগত নিধন হয়নি মিয়ানমারে। কোনো গণহত্যাও চালানো হয়নি। তিনি দাবি করেন, বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী  রোহিঙ্গা মুসলিম উগ্রপন্থিরা। তাদের সহিংসতার জন্যই মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে যেতে বাধ্য হয়েছে।

মানবিক বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরল বাংলাদেশ : জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, মিয়ানমার সরকার অভিযান বন্ধের কথা বললেও এখনো রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ হয়নি। এর ফলে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন কমপক্ষে ৫ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৯ লাখ সদস্য এখন বাংলাদেশে। তিনি এই পরিস্থিতিকে সমর্থন অযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেন। আবারও জাতিসংঘের কাছে আহ্বান জানান মিয়ানমারের ভিতরে একটি সেইফ জোন সৃষ্টি করতে। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, শরণার্থীরা বলছেন তাদের ওপর কীভাবে গণধর্ষণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছাড়া করতে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে মিয়ানমার। পাশাপাশি গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লোকজনের সবকিছু কেড়ে  নেওয়া হচ্ছে। তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এসব নৃশংসতা প্রমাণ করে, মিয়ানমার সরকার রাখাইনকে জনশূন্য করে দেওয়ার জন্য অস্ত্র হিসেবে অগ্নিসংযোগ করছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে শেখ হাসিনার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি : নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ছিলেন সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে এ মোমেন। তিনি সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ‘১৫ সদস্যের ১৩ জনই স্পষ্টভাষায় মিয়ানমারের সমালোচনা করেছে। রাশিয়া এবং চীনের বক্তব্য ছিল অস্পষ্ট। এটিই দুশ্চিন্তার কারণ। এমন একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, যা সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, মানবিক বিপর্যয় চরমে উঠেছে, অথচ চীন আর রাশিয়াকে যেভাবে সোচ্চার হওয়া উচিত, সেটি দেখলাম না।’ মোমেন বলেন, ‘মিয়ানমারের বক্তব্যে অসত্য তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে, যা কারোরই কাম্য ছিল না। কারণ, এখন প্রায় সবাই জেনে গেছেন মিয়ানমার সরকারের বর্বরোচিত আচরণের কথা।’ রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন উল্লেখ করেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের এ সভায় প্রায় সব বক্তাই উদ্ভূত পরিস্থিতির অবসানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উত্থাপিত ৫ দফা কর্মসূচির আলোকপাত করেছেন অর্থাৎ ওই প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ। সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত। তার বক্তব্যে শেখ হাসিনার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি ঘটেছে। তিনি কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন মিয়ানমার প্রশাসনের। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য, ১ অক্টোবর থেকে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবে ফ্রান্স। সে কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত এ সভায় বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করব না।’ রোহিঙ্গাদের এমন মানবেতর পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়া যায় না। সভ্য সমাজের প্রতিটি সদস্যের উচিত হচ্ছে এহেন বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

যদিও সব বক্তাই পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ অবসানের পরামর্শ দিয়েছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়ে ৫ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন।

সর্বশেষ খবর