শিরোনাম
শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৩০

সিমেন্টে বাঁধা শিশুর লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

সিমেন্টে বাঁধা শিশুর লাশ

নয় বছরের হাসমি খান। রাতে ঘরে বসে একা পড়ছিল। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বেরোয়। উঠানের এক কোণে টয়লেট। টয়লেটের কাজ সেরে ঘরে ফিরছে। কিন্তু আঁধারে লুকিয়ে থাকা দুই যুবক হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায়। হাসমি কিছুই বুঝতে পারল না। মুখ চেপে তারা হাসমিকে কোলে তুলে নিয়েই চম্পট।

বাড়ির কেউ কিছু বুঝতেই পারল না। ঘরে থাকা হাসমির বাবাও জানতে পারলেন না, তার বুকের ধনের সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না। হাসমি টয়লেট থেকে ফিরতে যখন দেরি করছিল, তখনই তার বুকটা কেমন করে ওঠে। এরপর শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। হাসমিকে আর পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায় তার লাশ। ঘাতকরা হাসমিকে জবাই করে হত্যার পর সিমেন্টের ব্যাগের সঙ্গে বেঁধে পুকুরে ফেলে দেয়। কিন্তু ঘাতকদের কোনো আশা পূরণ হয়নি। বিচারে আসামি চারজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়। ঘাতকদের মধ্যে অন্যতম আসামি হলেন হাসমির মা।

ঘটনাটি খুলনার। গত বছর আগস্টে অপহরণের পর খুনের ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর শিশু হাসমি মিয়া হত্যা মামলা নামে পরিচিত। মামলার বিচারে হাসমির মাসহ চারজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। তারা হলেন হাসমির মা সোনিয়া আক্তার, মো. নুরুন্নবী, মো. রসুল, মো. হাফিজুর রহমান। এ মামলায় খুলনার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোসাম্মাৎ দিলরুবা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। মায়ের সঙ্গে অন্যকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় দেখে ফেলে হাসমি। খুলনার আড়ংঘাটা থানা এলাকার সরদারডাঙ্গা শহীদ হাতেম আহম্মেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র হাসমি মিয়াকে (৯) তখনই খুন করা হয়। মা সোনিয়া আক্তারের সামনেই শিশুটিকে নৃশংসভাবে খুন করে তিন ঘাতক। বার বার শিশুটি তার মাকে ডেকে ডেকে বলছিল, ‘মা আমাকে বাঁচাও।’ তবুও মা ও তার সহযোগীদের মনে করুণা হয়নি বলে মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়। খুলনার মানিকতলার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন খানের মেয়ে সোনিয়ার বিয়ে হয় মো. হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। এর ছয় মাস পর হাফিজুর রহমান বিদেশে চলে যান। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সোনিয়ার চলাফেরা উচ্ছৃঙ্খল হতে থাকে। তিনি বিভিন্ন যুবকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। দেশে আসার পর বিষয়টি জানতে পারেন হাফিজুর রহমান। এরপর তিনি স্ত্রীকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তালাক দেন স্ত্রীকে। হাসমি থেকে যায় বাবার সঙ্গে। হাসমিকে তার বাবার কাছ থেকে অপহরণ করার পরিকল্পনা আঁটেন সোনিয়া। এর জন্য তার পরিচিত দুই যুবক নুরুন্নবী ও রসুলের সঙ্গে ৫০০ টাকা ও অনৈতিক কাজের চুক্তি হয় সোনিয়ার। ২০১৬ সালের ৬ জুন রাত পৌনে ৯টার দিকে শিশু হাসমিকে অপহরণ করে তার মায়ের কাছে নিয়ে আসা হয়। এরপর চুক্তি অনুযায়ী সরদারডাঙ্গা বাগানের (বাঁশঝাড়) মধ্যে পালাক্রমে অপহরণকারীরা সোনিয়ার সঙ্গে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। এ সময় শিশু হাসমি ঘটনা দেখে তার মাকে বলে, ‘মা তুমি কী করতেছ, আমি বাবাকে বলে দেব।’ এ ঘটনা বাইরে ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ঘাতকরা সোনিয়ার সামনেই শিশু হাসমিকে মুখ চেপে ধরে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ গুমের জন্য ওই রাতেই সিমেন্টের বস্তায় ভরে খুলনা বাইপাস সড়কসংলগ্ন সরদারডাঙ্গা বিলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ৯ জুন সকালে ওই বিলের মধ্য থেকে সিমেন্টের বস্তাবন্দী অবস্থায় হাসমির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সেদিনই হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে মো. নুরুন্নবী, হাফিজুর রহমান, মো. রসুলের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত দু-তিন জনের বিরুদ্ধে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুমের মামলা করেন (নম্বর ২)। তদন্ত কর্মকর্তা আড়ংঘাটা থানার এসআই মো. মিজানুর রহমান একই বছরের ৩০ জুন এজাহারভুক্ত হাফিজুর রহমান ও আসাদ ফকিরকে বাদ দিয়ে সোনিয়া আক্তার, মো. নুরুন্নবী ও মো. রসুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ওই চার্জশিটের বিরুদ্ধে বাদীর নারাজি আবেদনের পর পুনরায় তদন্ত শেষে সিআইডির পরিদর্শক মিঠু রানী দাস একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পর মামলাটি বিচারের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। ২ এপ্রিল অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ মামলার চার্জশিটভুক্ত দুজন আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠন হওয়া পাঁচ আসামি হলেন সোনিয়া আক্তার, মো. নুরুন্নবী, মো. রসুল, মো. হাফিজুর রহমান ও রাব্বি সরদার। এ ছাড়া অব্যাহতি পাওয়া দুজন হলেন মো. জসিম খান ও মো. আসাদ ফকির।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর