বৃহস্পতিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন মডেল

--------- অরুণ জেটলি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে যে সম্পর্ক বিরাজ করছে তাকে অন্য দেশগুলোর জন্য ‘অনুসরণযোগ্য মডেল’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা সফররত ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

গতকাল সকালে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাংলাদেশের সঙ্গে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির পর এ ধরনের মন্তব্য করেন পার্শ্ববর্তী দেশটির অর্থমন্ত্রী।

ভারতীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে, যা সাম্প্রতিককালে ক্রমবর্ধমান। ভারতের স্বার্থে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং আমরা আমাদের পারস্পরিক যোগাযোগ গভীর করতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে তার বৈঠক প্রসঙ্গে জেটলি বলেন, ‘আমি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিশেষ করে আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে পর্যালোচনা করেছি, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।’ অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রগতি দেখে তিনি ‘মুগ্ধ’ বলেও জানান। গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে অরুণ জেটলি বলেন, এর ধারাবাহিতায় দুই দেশের মধ্যে রেকর্ড ৩৬টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির বেশ কিছু বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন। জেটলি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমরা বাংলাদেশকে ৮০০ কোটি ডলারের তিনটি ঋণরেখা প্রদান করেছি। এ পর্যন্ত এটিই কোনো দেশকে দেওয়া ভারতের সর্বোচ্চ মাত্রার ঋণ।’ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ভারতীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সড়ক, রেল, জল ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচলসহ ১৯৬৫-পূর্ব সংযোগ পুনরুদ্ধারে আমাদের দুই দেশের সরকার গুরুত্ব আরোপ করেছে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারিত্ব, উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে যোগাযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে এ উদ্যোগ সাহায্য করবে বলেও মন্তব্য করেন জেটলি। বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ এবং ঢাকায় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোয় অর্থমন্ত্রী মুহিতকে ধন্যবাদ জানান অরুণ জেটলি। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। ভারত কর্তৃক প্রতিশ্রুত ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের এ ঋণ সহায়তা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এতে দুই দেশের উন্নয়ন অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলেও মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। মুহিত বলেন, ‘শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয়, আমরা অন্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

ভারত-বাংলাদেশের শিকড় ও চ্যালেঞ্জগুলো প্রায় এক : অরুণ জেটলি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের শিকড় এক। দুই দেশের চ্যালেঞ্জগুলোও প্রায় একই। যে কোনো দেশের বড় অংশের অর্থনীতি নগদ লেনদেনের ওপর বিকশিত হয়। দেশের অর্থনীতি যদি নগদ অর্থের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এ অর্থের অভিশাপ আপনাকে ভোগাবে।’ এ ক্ষেত্রে নগদকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে কর ফাঁকি, কালো টাকা, দুর্নীতি ও জঙ্গি অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন অরুণ জেটলি। তার মতে, নগদ মুদ্রানির্ভর অর্থনীতি দুর্নীতির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত গরিব মানুষের বিপক্ষে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে ভারতের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নতির পেছনে নগদবিহীন (ক্যাশলেস) ডিজিটাল লেনদেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গতকাল ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত ‘ম্যাক্রো ইকোনমিতে ভারত সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও সাফল্য’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি প্রধান বক্তা হিসেবে এসব কথা বলেন। ঢাকা সফররত অরুণ জেটলি বলেন, নগদবিহীন (ক্যাশলেস) ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানোর ফলে ভারতে ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে দেশটির রাজস্ব আয়। অন্যদিকে কমেছে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন। ফলে গোটা ভারতের অর্থনীতিতে এক ধরনের আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে ক্যাশলেস লেনদেন। ভারতের নেওয়া এসব উদ্যোগে বাংলাদেশ উদ্বুদ্ধ হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে একই অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকার শ্যামলীতে এবং বিভাগীয় শহর সিলেটে ভারতীয় ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারে ডিজিটাল লেনদেন কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। এ ছাড়া ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের বাংলাদেশ রিপ্রেজেনটেটিভ শাখার উদ্বোধন করা হয়। এখন থেকে ভারতীয় ভিসার আবেদন ফি মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা এটিএম কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করা যাবে। অনুষ্ঠানে ভারতীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ভারতের ৪২ শতাংশ লোক ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে ছিল, যার বেশির ভাগ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। তাই পরবর্তী সময়ে আমরা ডিজিটাল লেনদেনের ওপর জোর দিই এবং জনগণকে উৎসাহিত করি। ফলে নতুন করে ৩০ কোটি লোক ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আসে। বর্তমানে ৭০ শতাংশ লোক ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে, যার প্রধান কারণ ক্যাশলেস লেনদেন। অতীতে গ্রাহকরা ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরত। কিন্তু এখন ক্যাশলেস লেনদেন শুরু হওয়ায় ব্যাংক গ্রাহকদের কাছে যাচ্ছে। এ ছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট চালুর ফলে ভারতে বেনামি ঋণের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। এ ছাড়া ক্যাশলেস লেনদেনের কারণে আর্থিক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতিও অনেক কমে এসেছে।’

তিনি বলেন, গত বছর সরকার জনগণের হাতে থাকা নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা দিতে বলে। ফলে বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ কমে যায়। একই সঙ্গে ব্যক্তিপর্যায়ে কার কত অর্থ আছে সে তথ্য সরকারের হাতে চলে আসে। ফলে সরকারের রাজস্ব বাড়ছে। কমেছে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন। আর এসব উদ্যোগের কারণে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) নির্ণয় সহজ ও সঠিক হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে দুর্নীতি কমে। এ প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়বে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সময় ও খরচ তত কমবে। বাংলাদেশ সে পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। ভারতীয় হাইকমিশন ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের ১২টি ভিসা আবেদন কেন্দ্রকে ‘ক্যাশলেস’ সেন্টার ঘোষণা করেন অরুণ জেটলি। উদ্বোধনের পর রাজধানীর শ্যামলী ও সিলেটে ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের প্রথম দুজন ‘ক্যাশলেস’ ভিসা আবেদনকারীর কাজের প্রক্রিয়ার ভিডিও দেখানো হয় সরাসরি। জানানো হয়, এ প্রক্রিয়ায় ফি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিচালনা করবে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। একই অনুষ্ঠানে স্টেট ব্যাংক ইন্ডিয়ার চালু করা ট্র্যাভেল কার্ডের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ভারতের যে কোনো প্রান্তে ভ্রমণকারীরা এ কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন। এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরইউ) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার। এ ছাড়া অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, ভারতীয় হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং দুই দেশের ব্যবসায়ী নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর