শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্বকীয়তা হারাচ্ছে কক্সবাজার

ভেঙে পড়েছে শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস, পর্যটনশিল্পে ধস

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, টেকনাফ ও কক্সবাজার ঘুরে

স্বকীয়তা হারাচ্ছে কক্সবাজার

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চাপে পরিবেশ, পর্যটন ও জনজীবন নানা সংকটে পড়েছে। গতকাল উখিয়ার ঠেংখালী থেকে তোলা ছবি —রোহেত রাজীব

এক মাসের চেয়ে বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে স্রোতের মতো আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যার সংখ্যা এরই মধ্যে ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা জানিয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ ও এখানকার জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে দেশের শীর্ষ পর্যটনের শহর কক্সবাজার আজ ক্ষতবিক্ষত। সবচেয়ে সম্ভাবনাময়ী এই শহরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা কমে গেছে। জেলার উখিয়া থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত জনজীবন পুরোপুরি বিপন্ন। ভেঙে পড়েছে শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। গ্রামীণ এ জনপদে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। সবচেয়ে বড় কথা হলো, হাট-বাজারে এখন প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া দায়। লাখ লাখ মানুষের তুলনায় যানবাহনও কম। ১০ টাকার ভাড়া ২০ টাকা দিয়েও গন্তব্যে যাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কত দিন লাগবে তা কেউই স্পষ্ট বলতে পারছে না। কক্সবাজার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (দক্ষিণাঞ্চল) আলী কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পে প্রভাব ফেলছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এটা পর্যটনশিল্পে বড় আঘাত। এ ছাড়া আমাদের বন বিভাগের জন্যও হুমকি।’ রোহিঙ্গা প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পেও। বর্ষা শেষে চলতি শরৎ মৌসুমে প্রতিবছর যে পরিমাণ দেশি-বিদেশি পর্যটক কক্সবাজারে আসতেন, বর্তমানে তার সিকি পরিমাণও নেই। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো এখন ফাঁকা বললেই চলে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণকাজে জড়িত ছাড়া দেশি-বিদেশি কোনো পর্যটকের দেখা মিলছে না। অনেকে এখন কক্সবাজারে আসতে অজানা আশঙ্কায় ভুগছেন বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আনোয়ারুল্লাহ নাছের বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের উখিয়া, টেকনাফের মধ্যে রাখতে ১১টি স্থানে আমাদের চেকপোস্ট কাজ করছে। তাদের কক্সবাজার শহর বা পর্যটন এলাকায় আসতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই পর্যটনে প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। তবে স্থানীয় জনসাধারণ কিছু দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এটি আমরা অস্বীকার করছি না। এটি সাময়িক। বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে চিঠিও দিয়েছি। আশা করছি শিগগিরই এই অচলাবস্থা দূর হবে।’ সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার অধিকাংশ স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দীর্ঘ ১৫ দিন বন্ধ থাকার পর আগামীকাল শনিবার থেকে খুলছে। কিন্তু টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের পার্শ্ববর্তী সব স্কুল এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দখলে। সেখান থেকেই চলছে রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে সব ধরনের ত্রাণ কার্যক্রম। ফলে খোলার দিন হলেও স্কুল-মাদ্রাসায় অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের পরবর্তী অবস্থান কোথায় তা এখনো জানেন না। তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো আদেশ আসেনি বলে জানান মাঠপর্যায়ের সদস্যরা। সামনে ২২ নভেম্বর থেকে শুরু হবে পিএসসি পরীক্ষাও। তা নিয়েও উদ্বিগ্ন শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলার এটিও আশীষ ঘোষ বলেন, ‘আমার উপজেলায় ৬৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো পরশু (শনিবার) খুলবে। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসার পর বোঝা যাবে, তাদের প্রতিক্রিয়া কী। আর যেসব স্কুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নিয়েছে, সেগুলো ছাড়তে ইতিমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এই বিপুল অংশ কক্সবাজার জেলার উখিয়া, হ্নীলা, টেকনাফ ও রামুর কিছু এলাকা এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি জুড়ে অবস্থান নেওয়ায় এখানকার যোগযোগ ব্যবস্থায়ও নেমে এসেছে চরম অব্যবস্থাপনা ও অস্বাভাবিকতা। রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের আগে যে দূরত্বে সিএনজি ট্যাক্সি ও অটোরিকশার ভাড়া ছিল ৫০ টাকা, সেখানে কয়েক সপ্তাহ ধরে ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়ে গেছে। বাসের ভাড়াও বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রয়োজনমতো যানবাহনও পাওয়া দায়। সবাই ব্যস্ত রোহিঙ্গাদের নিয়ে। কিন্তু স্থানীয়রা যে চরম ভোগান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তা দেখার কেউ নেই।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের অধিবাসী মনির উল্লাহ বলেন, ‘আগে লম্বাবিল থেকে হ্নীলার সিএনজি ট্যাক্সি ভাড়া ছিল ১৫০ টাকা, তা বেড়ে এখন হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। লম্বাবিল থেকে হোয়াইক্যংয়ের টমটম ভাড়া ৫ টাকার স্থলে হয়েছে ১০ টাকা। আবার হোয়াইক্যং থেকে উখিয়ার ট্যাক্সি ভাড়া ৫০ টাকার স্থলে হয়ে গেছে ১০০ টাকা। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ ও স্কুল-কলেজগামী ছেলেমেয়েরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।’ রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের পর সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও শাক-সবজির। আগে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৫ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা দামে। বরবটির দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন হয়েছে ৭০ টাকা। শসার দাম ২০ টাকা থেকে হয়ে গেছে ৩৫ টাকা। ঢেঁড়শের দাম ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা, টমেটো ৭০ থেকে ৯০ টাকা হয়ে গেছে। এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘দাম বেড়েছে সেটা বড় কথা নয়, বাজারে গিয়ে টাকা দিয়ে কোনো কিছু কিনতে গেলেও মিলছে না। শাক-সবজি, মাছ-মাংসের যে অভাব দেখা দিয়েছে, তা আমার অতীত জীবনে কখনো দেখিনি।’ কক্সবাজারের রোদেলা রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটনশিল্প। আমাদের এখন খরা চলছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ঠিকই দিতে হচ্ছে অথচ ব্যবসা নেই। রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। পর্যটকদের ধারণা, কক্সবাজার এলেই রোহিঙ্গা নারী-শিশু তাদের ঘিরে ধরবে, ভিক্ষা চাইবে, ব্যাগ ধরে টানাটানি করবে। অথচ এখানে সে রকম কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর