শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

গহিন পাহাড়ে আলো ছড়াচ্ছে ‘পাড়াকেন্দ্র’

ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) থেকে

গহিন পাহাড়ে আলো ছড়াচ্ছে ‘পাড়াকেন্দ্র’

নাইক্ষ্যংছড়ির ছনখোলায় পাহাড়ের চূড়ায় পাড়াকেন্দ্রে চলছে খুদে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

‘একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব, নীল আকাশে সবুজ ঘাসে খুশিতে হারাব’— বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ছনখোলার একটি পাহাড়ের চূড়ার ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর থেকে সুমধুর কণ্ঠে এই ছড়াগানের সুর ভেসে আসছিল। এই সুরের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছিল কয়েকটি শিশুকণ্ঠ। ৩০ ফুট চূড়ায় উঠে দেখা যায়, একজন অল্পবয়সী মহিলা গুটিকয় শিশুকে এই সুরেলা কণ্ঠে ছড়াগানটি শেখাচ্ছেন। কুঁড়েঘরটি ঘুরে দেখা গেল, সেটি একটি প্রাক-প্রাথমিক স্কুল, যার দাফতরিক নাম ‘পাড়াকেন্দ্র’। কোনো সাইনবোর্ড না থাকলেও ভিতরে হাজিরা খাতায় স্কুলটির নাম লেখা আছে ‘বড় ছনখোলা পাড়াকেন্দ্র’। স্কুলঘরটির চারদিকে ভাঙা বেড়ায় বৃষ্টির ছিটা আসছিল ঘরের ভিতর। একপাশে ভাঙা একটি ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলে আছে। অন্যপাশে একটি বইয়ের আলমিরা অকেজোপ্রায়। মেঝের এক কোনায় দেখা গেল, কচি হাতের বানানো মাটির কিছু খেলনা। মেঝেতে মাদুর পেতে আটজন শিশুকে নিয়ে গোল হয়ে বসিয়ে পড়াচ্ছিলেন শিক্ষিকা ইসমত আরা। শিশুদের গায়ের পোশাকও ছিল জীর্ণশীর্ণ। ওদের কারও বয়সই পাঁচের ঊর্ধ্বে নয়। পাশে ঝোলানো শিক্ষা ক্যালেন্ডারটিও কয়েক বছর আগের। শিক্ষিকার সামনেই রাখা ছিল একটি হাজিরা খাতা, একটি ডাস্টার ও বাক্সভর্তি কিছু খড়িমাটি। হাজিরা খাতা খুলে দেখা গেল, ওই স্কুলে মোট ১৩ জন ছাত্রছাত্রী। শিক্ষিকা মাত্র ওই একজনই। ছাত্র-ছাত্রীরা হলো— মো. হাসেম, আমীর হোসেন, বেলাল উদ্দিন, মো. আবদুল্লাহ, মোস্তফা রহমান, মো. মোতাহের, ফাতেমা বেগম মুন্নি, ছাবিয়া সুলতানা সিমরান, উম্মে মরিয়ম, উম্মে হাবিবা রেশমি, হোসনে আরা বেগম, মো. আবদুল্লাহ আল মামুন ও রফিকুল ইসলাম। ক্লাসে উপস্থিত ছিল আট শিশু শিক্ষার্থী। সবার সামনেই ছিল শিক্ষা বোর্ডের একটি শিশুপাঠ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। ঘরটির বিপরীত পাশে দেখা যায় আরেকটি বোর্ড, যেখানে লেখা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি’। তবে সেই বোর্ডটিও বেশ পুরনো দেখাচ্ছিল।

বাংলায় লেখা জাতীয় সংগীতও ঠিকমতো পড়া যাচ্ছিল না। শিক্ষিকা ইসমত আরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, স্কুলে আসা শিশুদের প্রায় সবাই নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান। তাদের কোনো ড্রেসকোড নেই। মূলত এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীকে বাংলা বর্ণ পরিচয় শেখানো হয়। স্কুলে বাচ্চারা থাকতে চায় না। তাদের অনেক বুঝিয়ে ধরে রাখতে হয়।

জানা যায়, শুধু বড় ছনখোলাতেই নয়, পুরো নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম পাহাড়ের গহিনে এমন ১৭৯টি পাড়াকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ছাত্রছাত্রী রয়েছে সর্বমোট ৩ হাজার ৬১৫ জন। প্রতিটি স্কুলে একজন করে শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকা রয়েছেন, যাদের মাসিক বেতন সাড়ে ৩ হাজার টাকা। ১০টি স্কুলের জন্য একজন সিনিয়র পাড়াকর্মী রয়েছেন। তারা নিয়মিত স্কুলগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। এ ছাড়া ওই থানায় একজন প্রজেক্ট অর্গানাইজার (প্রকল্প সমন্বয়ক) রয়েছেন। তার নাম আবদুর রহমান। তিনিও মাঝেমধ্যে স্কুল পরিদর্শন করে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করেন। স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাক-প্রাথমিকে সরকারি বর্ণ পরিচয়ের বই, ছড়ার বই আর চিত্রাঙ্কন শেখানো হয়।

এ ছাড়া পাহাড়ি ভাষাও শেখানো হয়। তবে কোনো ইংরেজি বই পড়ানো হয় না। শিক্ষক-শিক্ষিকার যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়েছে সর্বনিম্ন নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন। প্রতিষ্ঠানগুলোয় ৯৮ ভাগ নারী শিক্ষিকা। জানা যায়, সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত স্কুলের কার্যক্রম চলে। সর্বোচ্চ ১০০টি পরিবার ঘিরে একেকটি স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। এই স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স সর্বোচ্চ ছয় বছর। ছাত্রছাত্রীদের ধরে রাখতে ওয়ার্ল্ড ফুড অর্গানাইজেশন থেকে বিস্কুটও খাওয়ানো হয়। তবে ঝরে পড়া শিশুদের জন্যও নেওয়া হয়েছে কার্যকর উদ্যোগ। অভিভাবকদের সচেতন করতে পাড়াগুলোয় নিয়মিত মতবিনিময় সভাও করা হয়। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার প্রকল্প সমন্বয়ক আবদুর রহমান জানান, প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। আবার নতুন করে প্রকল্প শুরু হবে। সেখানে প্রতিটি স্কুলের জন্য অন্তত পাঁচ শতাংশ জমি বরাদ্দ থাকবে। পাহাড়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাড়াকেন্দ্রগুলোকে যুগোপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপই নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর