রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অনাস্থা আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির

প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ ১১ অভিযোগ । পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনে আইনজীবীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

অনাস্থা আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতির

বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেওয়া লিখিত বিবৃতিকে বিভ্রান্তিমূলক বলে আখ্যায়িত করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। প্রধান বিচারপতি শুক্রবার রাতে বিদেশ যাত্রার আগে গণমাধ্যমে লিখিতভাবে যে বক্তব্য দেন, তার জবাবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন গতকাল এ বিবৃতি দিল। সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এ ধরনের বিবৃতি একেবারেই বিরল। অথচ সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১ অভিযোগের পর তার সঙ্গে আদালতের এজলাসে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বাকি পাঁচ বিচারপতি। এ অবস্থায় প্রথমে তিনি পদত্যাগ করতে চাইলেও পরে রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটি চেয়ে দরখাস্ত করেন। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বঙ্গভবনে ডেকে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ওইসব অভিযোগের দালিলিক তথ্য দেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১ অভিযোগ উঠেছিল। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধান বিচারপতি ছাড়া আপিল বিভাগের বাকি পাঁচ বিচারপতিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান।রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে বঙ্গভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আপিল বিভাগের চারজন বিচারপতি। তারা হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন,   বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতি মো. ইমান আলী দেশের বাইরে থাকায় আমন্ত্রিত হয়েও বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সেদিন সাক্ষাতে যেতে পারেননি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, চার বিচারপতির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সংবলিত দালিলিক তথ্য-উপাত্ত তাদের কাছে হস্তান্তর করেন রাষ্ট্র্রপতি। এসবের মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ বৈঠকের পর বিচারপতি ইমান আলী দেশে ফিরলে ১ অক্টোবর আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতি নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেন। তারা ওই ১১টি অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এরপর তারা এসব অভিযোগ বিচারপতি সিনহাকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। বৈঠকে সেদিন পাঁচ বিচারপতি এ সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন যে, ওইসব গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তিনি কোনো সন্তোষজনক জবাব না দিতে পারলে তার সঙ্গে বিচারালয়ে বসে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এরপর ১ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ওই পাঁচজন বিচারপতি তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে অভিযোগগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলেও প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় আপিল বিভাগের ওই পাঁচজন বিচারপতি তাকে সুস্পষ্টভাবে জানান, ‘এমতাবস্থায় ওইসব অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তার (প্রধান বিচারপতি) সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে তাদের (পাঁচ বিচারপতি) পক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে না’। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সুস্পষ্টভাবে তাদের বলেন, সে ক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে এ ব্যাপারে তিনি পরদিন তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। কিন্তু ২ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সিনহা আপিল বিভাগের ওই পাঁচ বিচারপতিকে কিছু না জানিয়েই এক মাসের ছুটি চেয়ে দরখাস্ত দিলে রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন। একই সঙ্গে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার পালনের দায়িত্ব দেন রাষ্ট্রপতি। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে এর আগে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বক্তব্য বা বিবৃতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্দেশক্রমে এ বিবৃতি দেওয়া হলো।

প্রসঙ্গত, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সমালোচনার মুখে ছিলেন প্রধান বিচারপতি সিনহা। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি শেষের আগের দিন অসুস্থতার কারণে ২ অক্টোবর এক মাসের ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন সিনহা। যদিও তিনি বিদেশ যাওয়ার সময় গণমাধ্যমকে জানান, তিনি সুস্থ আছেন। পালিয়ে যাচ্ছেন না।

পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন : ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দেওয়া বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা। গতকাল সভাপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে একাংশ প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে সমিতির সহ-সভাপতি মো. অজি উল্লাহ পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেন। আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ওই সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সহ-সভাপতি মো. অজি উল্লাহর নেতৃত্বে অপর অংশ সংবাদ সম্মেলন করতে এলে বিএনপি-সমর্থক ও আওয়ামী লীগ-সমর্থকদের মধ্যে বাদানুবাদ দেখা দেয়। পরে আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রপতি। কাজেই রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান, বিচার বিভাগকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন।’ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রাষ্ট্রের তিন বিভাগ—শাসন, আইন ও বিচার বিভাগ। সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক। সেই অভিভাবককে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অভিমান দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানাচ্ছি, অভিমান ভুলে বিচার বিভাগ রক্ষায় এগিয়ে আসুন।’ সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট জয়নুল বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে আইনমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন, সে সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে গেলেন যে অতীতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কখনো করেননি। এই আইনজীবী সমিতি মনে করে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার জন্য অন্তত ধীর থাকবেন।’ সংবাদ সম্মেলনে সহ-সভাপতি উম্মে কুলসুম বেগম, সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন, সহ-সম্পাদক শামীমা সুলতানা, সদস্য শেখ তাহসিন আলী উপস্থিত ছিলেন।

পৃথক সংবাদ সম্মেলনে সহ-সভাপতি অজি উল্লাহ বলেন, ‘সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। আমরা এর সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করছি। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি ছুটি নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন স্বেচ্ছায়। ছুটি শেষে আবার ফিরে আসবেন। বিচারকাজ পরিচালনা করবেন।’ প্রশাসনিক পরিবর্তন নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একমত নন জানিয়ে অজি উল্লাহ বলেন, ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে যাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেওয়া হবে, তিনিই প্রশাসনিক ও বিচারিক সব কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। সাংবিধানিকভাবে তার এ কাজ পরিচালনায় বাধা নেই। এ নিয়ে সভাপতি-সম্পাদক বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির ‘বিব্রত’ হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অজি উল্লাহ বলেন, রায় প্রকাশের পর রায় নিয়ে যে কোনো গোষ্ঠী সমালোচনা করতে পারেন। ওই সমালোচনার জন্য কারও ব্যথিত, দুঃখিত, বিব্রত বোধ করা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। গঠনমূলক সমালোচনা করা ব্যক্তিগত অধিকারের পর্যায়ে পড়ে।

সর্বশেষ খবর