রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফের চীন- রাশিয়ার বিরোধিতা রোডম্যাপ চান কফি আনান

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

ফের চীন- রাশিয়ার বিরোধিতা রোডম্যাপ চান কফি আনান

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান। তিনি বলেন, এ শরণার্থী সংকট নিরসনে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোকে অবশ্যই মিয়ানমারের সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদকে তৈরি করতে হবে একটি রোডম্যাপ।

শুক্রবার মধ্যরাতে নিউইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি কফি আনান এ আহ্বান জানান। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই পরিষদ কফি আনানকে মিয়ানমারের সত্যিকারের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করতে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে তিনটি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব পাস করা যায়নি স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে। এর আগে গত ২৮ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর তিনবার বৈঠক করে নিন্দা ও উদ্বেগ জানানো ছাড়া কিছুই করতে পারেনি নিরাপত্তা পরিষদ।

জানা যায়, শুক্রবার মধ্যরাতে নিউইয়র্কে  জাতিসংঘ সদর দফতরের ইকোসক চেম্বারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আরিয়া ফর্মুলা সভায় অংশ নেন। আরিয়া ফর্মুলার এই সভার আয়োজন করে ব্রিটিশ ও ফরাসি ডেলিগেশন। অ্যাডভাইজরি কমিটি অন রাখাইন স্টেট এর চেয়ারম্যান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের কাছে রাখাইন পরিস্থিতি এবং সংকট নিরসনের সুপারিশ সম্পর্কে জেনেছেন পরিষদের সদস্যরা। বৈঠকে পরিষদের সদস্য দেশগুলো ছাড়াও জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস উপস্থিত ছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী ও ১০ অস্থায়ী সদস্যদের বাইরে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রতিনিধিরা সেখানে বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া অফিস অব দ্য হাইকমিশন অব হিউম্যান রাইটস, অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স, ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধি, ওআইসি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য রাখেন বৈঠকে। বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে খবরে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের আগের বৈঠকের মতো গতকালও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে কথা হয়েছে। চেষ্টা ছিল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের একটি সর্বসম্মত প্রস্তাবের। ফ্রান্স আর যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপের পক্ষে থাকলেও চীন আর রাশিয়ার বাধায় তা হয়ে ওঠেনি। সম্ভব হয়নি সেই পদক্ষেপের ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি।

সূত্রের বরাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর, বৈঠকে কফি আনান তার বক্তব্যে সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশ করা ‘অ্যাডভাইজরি কমিটি অন রাখাইন স্টেট’-এর রিপোর্টের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেন। রাখাইন প্রদেশের জনগণের স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও চলমান সংকট সমাধানের লক্ষ্যে মিয়ানমার সরকার তার কমিশন প্রণীত রিপোর্টের সুপারিশমালার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে বলেও কফি আনান আশা প্রকাশ করেন। কফি আনান রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তার সঙ্গে নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন, মানবিক সহায়তা ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত নিরাপত্তা ও দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে সহযোগিতা রক্ষা করার বিষয়ে জোর দিয়ে কফি আনান বলেন, ‘এই সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় দেশই লাভবান হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ভয়াবহ রোহিঙ্গা সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাখাইন প্রদেশের জনগণের কল্যাণে মিয়ানমার সরকার, রাখাইন জনগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একমত হয়ে কাজ না করে।’ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যই এ সংকট সমাধানের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি এটিকে মানবিক বিপর্যয় আখ্যা দিয়ে বলেন, অনেক হয়েছে। আমরা এটি আর গ্রহণ করতে পারছি না। আমরা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এই হীন কাজের নিন্দা জানাই।’ নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর কফি আনান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এমন এক প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি, যার ফলে শরণার্থীদের সম্মানজনকভাবে ফেরত নিতে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকার বাধ্য হয়। তাদের কোনো ক্যাম্পে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত হবে না। পুনর্বাসনে তাদেরকে সহযোগিতা করতে হবে। কফি আনান বলেন, মিয়ানমারের ব্যাপারে একটি রোডম্যাপ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদকে একমত হতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এ অঞ্চলে আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এই ক্ষত হবে গুরুতর। অন্যদিকে, জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত ম্যাথু রিক্রফট জানিয়েছেন, সহিংসতা নিরসন, মানবিক সহায়তার শর্তহীন অবাধ প্রবেশাধিকার এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে পরিষদের সদস্যরা একমত হয়েছে। এ সংকট উত্তোরণের পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে আরও কাজ করবে নিরাপত্তা পরিষদ।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈঠকে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, মিয়ানমার সরকারের দেওয়া বিবৃতি আর রাখাইন প্রদেশের প্রকৃত পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের র‌্যাপিড রেসপন্স মিশনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এমনটিই তুলে ধরা হয়েছে। ২৫ আগস্টের পর থেকে আজ (শুক্রবার) সকাল পর্যন্ত ৫ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখে। গত মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে মিয়ানমার পরিস্থিতির সমাধানে যে পাঁচটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছিলেন, রাষ্ট্রদূত নিজের বক্তৃতায়ও সেগুলো তুলে ধরে বলেন, ‘সহিংসতা ও একটি জাতিকে নির্মূলের প্রক্রিয়া বন্ধ, মিয়ানমারে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন প্রেরণ, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেফ জোন তৈরি, জোরপূর্বক উচ্ছেদকৃত মানুষদের নিজ ভূমিতে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবর্তন এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। রাষ্ট্রদূত মোমেন আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উপর্যুপরি উসকানি এবং বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন সত্ত্বেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছে এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে।’ তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন হবে।’ এ ধরনের কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের অংশগ্রহণ ও তদারকি ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল সমস্যা সমাধান করা কঠিন হবে।’ স্থায়ী প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীর উক্তি উল্লেখ করে বলেন, ‘এই সংকটের শিকড় মিয়ানমারে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারে নিহিত।’

সর্বশেষ খবর