সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা বললেন

বিএনপি বহু উন্নয়ন করেছে, জিয়ার হাতে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপি বহু উন্নয়ন করেছে, জিয়ার হাতে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা

নির্বাচন কমিশনে গতকাল সংলাপে বিএনপি নেতারা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিএনপির সঙ্গে সংলাপে দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেন, ‘তার (জিয়া) হাত দিয়েই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। ব্যক্তি এবং দলনেতা হিসেবে জিয়াউর রহমান ছয় বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। বিএনপি সরকার দেশে         বহুবিধ উন্নয়ন করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে বিএনপি সরকার দেশে প্রকৃত নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে।’ গতকাল বেলা ১১টায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে সিইসি কে এম নূরুল হুদা এসব কথা বলেন। সূচনা বক্তব্যে তিনি বিগত বিএনপি সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন।  সিইসির সভাপতিত্বে এ সংলাপ শুরু হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়। এ সময় অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। সংলাপে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি ‘সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ২০০৮ সালের পূর্বের নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্বহাল, ইভিএম-ডিভিএম পদ্ধতি চালু না করা, এক-এগারো থেকে শুরু করে বর্তমান সরকার কর্তৃক দলের চেয়ারপারসনসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহারসহ ২০ দফা প্রস্তাব করেছে দলটি।

সংলাপের শুরুতে লিখিত বক্তব্যে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি প্রায় নয় বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। পরে ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। সংলাপে উপস্থিত বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, সংলাপে যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের অনেকেই সরকারের মন্ত্রী হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে সংসদ পরিচালনা করেছেন। মন্ত্রী থাকাকালে আপনাদের অনেকের অধীনে আমি চাকরি করার সুযোগ পেয়েছি। অনেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিকবার নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনায় ভূমিকা রেখেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে বিএনপি সরকার দেশে ‘প্রকৃত নতুন ধারার’ প্রবর্তন করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সিইসি বলেন, বিএনপি সরকার দেশে বহুবিধ উন্নয়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে— প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলককরণ, পৃথক প্রাথমিক গণশিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, আইন কমিশন গঠন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ বছরে উন্নীতকরণসহ অনেক উন্নয়ন ও সংস্কারমূলক কার্যক্রম। বিএনপিকে ‘সফল রাষ্ট্র পরিচালনার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা’ থাকা একটি ‘বৃহৎ রাজনৈতিক দল’ হিসেবে বর্ণনা করেন সাবেক এই আমলা। তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের আজকের সংলাপের দিকে জাতি তাকিয়ে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন অধীর আগ্রহ ও অত্যন্ত আন্তরিকতা নিয়ে অপেক্ষা করছে। কমিশন বিএনপির সঙ্গে সফল সংলাপ প্রত্যাশা করে। এ সংলাপে বিএনপিই ‘সবচেয়ে বেশি লাভবান’ হবে বলে মন্তব্য করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নূরুল হুদা সিইসির দায়িত্ব পাওয়ার পর বিএনপি অভিযোগ তোলে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সময় ঢাকায় গঠিত জনতার মঞ্চে যোগ দেওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তবে নূরুল হুদা বরাবরই ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। এ ছাড়া বর্তমান সিইসিকে ২০০১ সালে যুগ্ম সচিব থাকা অবস্থায় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। পরে আদালতের রায় পেয়ে সচিব হিসেবে তিনি অবসরে যান। 

সংলাপে বিএনপির প্রস্তাব : সংলাপে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে ‘সহায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনসহ ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।  এ ছাড়া ১/১১ সরকার কর্তৃক দলের চেয়ারপারসনসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার, বর্তমান সরকারের আমলে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, গুম-খুন-হয়রানি ও ভীতি সঞ্চার বন্ধ করা, সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধিকার নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের কার্যকর সংলাপ অনুষ্ঠানে ইসিকে উদ্যোগ গ্রহণ করা, আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্তকরণ, ২০০৮ সালের আগে নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্বহাল, প্রশাসনকে দলীয়মুক্তকরণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, নির্বাচনের ৬ মাস আগে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে ন্যস্ত করা, নির্বাচনকালীন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব সিদ্ধান্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা একক কোনো কমিশনারের সিদ্ধান্তে নয়, কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রহণ, নির্বাচন-পূর্ব সময়ের শুরুতে সব মেট্রোপলিটন কমিশনার, ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি পরিবর্তন করা, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার প্রদান করা, মনোনয়নপত্র দাখিলের ক্ষেত্রে বর্তমান বিধানের সঙ্গে ‘নির্বাচন কমিশন’ এবং ‘অনলাইনে’ দাখিলের বিধান প্রবর্তন, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জামানত হিসেবে ‘নগদ বা ক্যাশ’ অর্থ জমাদানের বিধান বাতিল করা, ভোট গ্রহণ শেষে সব পোলিং এজেন্টের উপস্থিতিতে ভোট গণনা করা, প্রিসাইডিং অফিসার কর্তৃক ভোট গণনার স্বাক্ষরিত বিবরণী উপস্থিত প্রত্যেক এজেন্টকে প্রদান না করে ভোট কেন্দ্র ত্যাগ না করা, রিটার্নিং অফিসার ভোট গ্রহণের দিনই কেন্দ্রভিত্তিক প্রাপ্ত ফলাফল একত্রীকরণ করে প্রার্থীদের কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বেসরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণা করা, নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিজয়ী প্রার্থীদের গেজেট প্রকাশ করা।

তফসিল ঘোষণার পর সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সভা-সমাবেশ-পথসভার অনুমতি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের কাছে ন্যস্ত করা, দল বা প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণের সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রদান, দেশীয় পর্যবেক্ষক ও পর্যবেক্ষণ সংস্থার নিবন্ধন ও মনোনয়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা আনা, অধিক সংখ্যক বিদেশি পর্যবেক্ষককে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে উৎসাহিত করা। বন্ধ ঘোষিত গণমাধ্যম চালু করা, গণমাধ্যমে সব দল ও প্রার্থীর প্রচারণায় সমতাভিত্তিক সুযোগ প্রদান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, আইসিটি অ্যাক্টের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল, নির্বাচনের দিন মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক চালু রাখা, মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইন্টারসেপ্ট করতে পারে এমন সংস্থাগুলো হতে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের অপসারণ করে সেখানে নিরপেক্ষ ও পেশাদার কর্মকর্তাদের পদায়ন, প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রভৃতি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আড়াই ঘণ্টার সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি বিশ্বাস করতে চায়, নির্বাচন কমিশনের এ সংলাপ বা রোডম্যাপ বা পথ নকশা নিছক কালক্ষেপণ বা লোকদেখানো কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে না। এ সংলাপ যেন প্রহসনে পরিণত না হয় তা কমিশনকেই নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতা, দক্ষতা ও নির্ভীক পদক্ষেপ সমগ্র জাতি প্রত্যাশা করে। জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য বিএনপি ইসিকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতে চায়।

সংলাপে সন্তুষ্ট হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের যে একটা প্রচণ্ড রকমের অগণতান্ত্রিক আচরণ, সেখানে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে বলে তো আমরা মনে করি না। আশার যাত্রাটা শুরু হলো কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা কিছুটা আশাবাদী তো বটেই। বিএনপির দেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে মির্জা ফখরুল বলেন— তারা (ইসি) বলেছেন, তারা চেষ্টা করবেন, ভবিষ্যতে যাতে একটা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারেন। তার জন্য তাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখবেন। তারা (ইসি) এও বলেছেন, আপনাদের (বিএনপি) প্রস্তাবগুলো আমাদের কাছে অত্যন্ত উপযোগী হয়েছে, সুচিন্তিত হয়েছে, আমরা উপকৃত হব। তারা মনে করছেন, প্রস্তাবগুলো তাদের ভবিষ্যতের কাজের জন্য সুবিধা হবে। তিনি বলেন, তারা (ইসি) বলেছেন, তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তবে এ কথা তারা স্বীকার করেছেন, দেশে বর্তমানে সেই অবস্থা নেই যে তাদের দায়িত্ব পুরো পালন করতে পারেন। এটাও বলেছেন, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গণতন্ত্রের যে আসল রূপ, সেই রূপ বাংলাদেশে নেই। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন— দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ এস এম আবদুল হালিম, সাবেক সচিব ইসমাঈল জবিউল্লাহ ও আবদুর রশীদ সরকার।

সর্বশেষ খবর