সোমবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এস কে সিনহার দুর্নীতি তদন্তের কথা জানালেন আইনমন্ত্রী

সুপ্রিম কোর্টে রেজিস্ট্রারসহ ব্যাপক রদবদল

নিজস্ব প্রতিবেদক

এস কে সিনহার দুর্নীতি তদন্তের কথা জানালেন আইনমন্ত্রী

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, নৈতিক স্খলনসহ যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিনি বলেন, এলিগেশন যেহেতু উঠেছে, যেভাবে অনুসন্ধান করতে হয় সেটা হবে। অনুসন্ধানের পর যদি সত্যতা পাওয়া যায় তবে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কেউ কিন্তু আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইনে যা বলা আছে সবার ব্যাপারে তা পালন করা হবে। গতকাল সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন আইনমন্ত্রী। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার জবাবে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ও প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব মো. আনিসুর রহমানসহ সুপ্রিম কোর্টের ১০ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। গতকাল আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইনি পদক্ষেপ কী হবে? জবাবে তিনি বলেন, আপনারা জানেন, দুর্নীতির অভিযোগ কে তদন্ত করে। আমাকে কি বলে দিতে হবে যে অ্যান্টি করাপশন কমিশন-২০০৪ সালের আইনে একটি ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যান্টি করাপশন কমিশন আছে। এটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যাপার বলে আমার মনে হয় না। তিনি বলেন, যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, এর সবগুলোই দুর্নীতি দমন কমিশনের আওতায়, তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন কে অনুসন্ধান করবে। কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান দুদক নিজেও করতে পারে বা কেউ তাদের কাছে পাঠাতেও পারে। এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নেই, সংসদের ক্ষমতা নেই, এই অবস্থায় একজন বিচারপতির অভিযোগের তদন্ত কীভাবে হবে? এ বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, এখানে একটা ভ্যাকুয়াম (শূন্যতা) আছে। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির কিছু ক্ষমতা আছে, সেটা তিনি ব্যবহার করতে পারেন। এই এলিগেশনগুলোর অনুসন্ধান হতে হবে, যদি অনুসন্ধান হয়, সেখানে সত্যতা পাওয়া যায় তখন মামলা হবে। মামলার পর তদন্ত হবে। তখন প্রশ্ন আসবে মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রধান বিচারপতি বিদেশ যাওয়ার এক দিন পর এ অভিযোগগুলো ওঠায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তিনি তো কথা বলার সুযোগ পেলেন না— এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যে বিবৃতি দিয়েছে তা তো আমার নিয়ন্ত্রণে নয়। এ ব্যাপারে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। সুপ্রিম কোর্টের এভাবে বিবৃতি দেওয়া ঠিক হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা ওনাদের জিজ্ঞাসা করুন। এই অভিযোগের পর এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করতে পারবেন কিনা? জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, আমার সামনে যে তথ্য রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত না এই ১১টি এলিগেশনের ব্যাপারে সুরাহা হবে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা হয়তো তার (প্রধান বিচারপতি) সঙ্গে বসবেন না। তাহলে তিনি কী করে এখানে এসে বসবেন। আপিল বিভাগে একক বেঞ্চের কোনো নিয়ম আছে বলে আমার জানা নেই। ১১টি অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি জানেন, তারপরও প্রধান বিচারপতিকে বিদেশে যেতে দেওয়া হলো কেন এমন প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আছেন। উনি ছুটি নিয়েছেন, নিজে স্বীকার করেছেন যে ১০ নভেম্বরের মধ্যে আসবেন। বিচারপতির আসনটা একটা প্রতিষ্ঠান। এই আসনটা যিনি অলঙ্কৃত করবেন তাকে যদি অভিযুক্ত করতে হয়, ব্যবস্থা নিতে হয় তবে সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। খামখেয়ালিভাবে তাড়াহুড়া করে প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া আমরা মনে করি সমীচীন নয়। প্রশ্ন ছিল আপিল বিভাগের বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন কিনা- জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, তারা তার সঙ্গে বসেন। তাদের রিলেশনশিপ আলাদা। যখন রাষ্ট্রপতি অভিযোগগুলো দিয়েছেন, তারা জেনেছেন। সেভাবে তাকে (প্রধান বিচারপতি) গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন ও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়ে তো আমাদের কিছু বলার নেই। এস কে সিনহা দেশ ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের কাছে সরবরাহ করা বিবৃতিতে বলেছেন, প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। এস কে সিনহার এই বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি যে কাজ করতে পারেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি ঠিক সেই একই কাজ করতে পারেন। সেটাই সংবিধানে ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমার বলতে হয়- মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা আইনসঙ্গত নয়। এস কে সিনহার বিবৃতির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি যখন বাসস্থান ত্যাগ করেছেন তখন কাউকে অ্যাড্রেস না করে একটি লিখিত জিনিস দিয়েছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি তার এই বক্তব্যে নিশ্চয়ই হতভম্ব। এর কারণ হচ্ছে, দেশের প্রধান বিচারপতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে নিজ হস্তে সই করে চিঠি লিখেছেন, কী লিখেছেন তা আমি আপনাদের পড়ে শুনিয়েছি। তিনি যে অসুস্থ সেই কথা বলেছেন। আবার সাত দিন পর তিনি বলছেন, তিনি সুস্থ। ওই সময় হয়তো ডাক্তারি পরীক্ষা করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা যখন হয়নি তাই আমি আর এটা বাড়াতে চাই না। প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্যে সরকার বিব্রত কিনা- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, সরকার বিব্রত হয়নি। বরং প্রধান বিচারপতি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তাতে তিনি নিজেই বিব্রত হওয়ার কথা। তিনি পালিয়ে যাচ্ছেন না বলেছেন। কিন্তু তাকে তো কেউ পালিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে আনিসুল হক বলেন, প্রধান বিচারপতির ছুটির দরখাস্ত নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, তার অসুস্থতা নিয়েও অনেকে অনেক কথা বলছেন। কিন্তু এটা সত্য নয়। রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা প্রধান বিচারপতি সিনহার ছুটির চিঠি, সেই চিঠির আলোকে আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে লেখা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার জাকির হোসেনের ফরোয়ার্ডিং চিঠি পড়ে শোনান। একই সঙ্গে রেজিস্ট্রারের কাছে এস কে সিনহার বিদেশ সফর নিয়ে তার একান্ত সচিব আনিসুর রহমানের লেখা চিঠিও পড়ে শোনান। ওই চিঠিতে একান্ত সচিব লিখেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মহোদয় দীর্ঘদিন বিচারকাজে থাকায় এবং অবসর গ্রহণের তারিখ নিকটবর্তী হওয়ায় মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত মর্মে অবগত করেছেন। মানসিক অবসাদ দূর করার জন্য তিনি আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য গমন ও অবস্থানের মনঃস্থির করেছেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধান বিচারপতি বাচনিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।’ এই চিঠির বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে লেখা আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার জাকির হোসেনের ফরোয়ার্ডিং চিঠিটিও পড়েন মন্ত্রী। আইনমন্ত্রী বলেন, এই দুটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। এর বিষয়ে জিও (সরকারি আদেশ জারি) করা হয়েছে। আনিসুল হক বলেন, আমার মনে হয়, প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে কোনো বিতর্ক সৃষ্টির কারণ ছিল না। কিছু কিছু রাজনৈতিক মহল কোনো ইস্যু না থাকার কারণে খড়কুটো দিয়ে ইস্যু তৈরি করার অভিপ্রায়ে এটাকে একটা ইস্যু করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, যারা এটা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করছেন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হাসিল হয়নি বলেই তাদের এই মায়াকান্না।

সুপ্রিম কোর্টের ১০ কর্মকর্তাকে বদলি : এদিকে রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম ও প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব মো. আনিসুর রহমানসহ সুপ্রিম কোর্টের ১০ কর্মকর্তাকে গতকাল বদলি করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিচার বিভাগীয় এসব কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে বলে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার প্রস্তাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রেজিস্ট্রার জেনারেল পদটি সৃষ্টি করে সরকার। ওই বছরের ১৪ জুন সৈয়দ আমিনুল ইসলাম দেশের বিচার বিভাগে প্রথম রেজিস্ট্রার জেনারেল পদে নিয়োগ পান। গতকালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তাকে ঢাকার নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান, হাই কোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. আবু সৈয়দ দিলজার হোসেনকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিশেষ জজ, হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. যাবিদ  হোসেনকে রংপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজকে লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব মো. আনিসুর রহমানকে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তীকে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং হাই কোর্টের স্পেশাল অফিসার এ ই এম ইসমাইল হোসেনকে বরগুনার অতিরিক্ত  জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে বদলি করা হয়েছে। হাই কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. আজিজুল হককে ঠাকুরগাঁওয়ের যুগ্ম জেলা জজ ও দায়রা জজ, বেগম ফারজানা ইয়াসমিনকে পিরোজপুরের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ কামাল হোসেন শিকদারকে চুয়াডাঙ্গার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট মিটিং আজ : সুপ্রিম কোর্টে ফুলকোর্ট মিটিং ডেকেছেন প্রধান বিচারপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। আজ বিকাল ৪টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেজ লাউঞ্জে এ মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. আজিজুল হকের স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল এ তথ্য জানা গেছে। মিটিংয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত থাকবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এর আগে ৩ অক্টোবর দায়িত্ব গ্রহণ করে প্রথম ফুলকোর্ট মিটিং ডাকেন প্রধান বিচারপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা।

সর্বশেষ খবর