মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

থামছে না রোহিঙ্গা স্রোত

নো ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান ♦ নৌকাডুবিতে লাশ উদ্ধার ♦ ত্রাণ শিবির পরিদর্শনে মালয়েশীয় উপপ্রধানমন্ত্রী

ফারুক তাহের, আঞ্জুমানপাড়া (কক্সবাজার) থেকে

থামছে না রোহিঙ্গা স্রোত

উখিয়ায় গতকাল দলে দলে প্রবেশ করে রোহিঙ্গারা —এএফপি

ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় আবারও নেমেছে রোহিঙ্গা ঢল। এই ঢল যেন থামছেই না। গতকাল সকাল ১০টা থেকে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ওপারে অপেক্ষা করছে আরও প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা। এটিই এ পর্যন্ত আসা রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বড় ঢল। একদিনেই এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার স্রোত আর আসেনি বলে জানান স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসী।

এদিকে আবারও নাফ নদেও মোহনায় ফের রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড সদস্য ও স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ঘুরে গেলেন মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে।

বেলা ২টার দিকে সীমান্ত এলাকায় খানিকটা বৃষ্টিও হয়। এতে পরিবেশ আরও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। বরাবরের মতো এবারও রয়েছে নারী-শিশুর আধিক্য। ৫ থেকে ৭ দিন হেঁটে মিয়ানমারের নাইছাদং ও কুয়াংছিদং, পাদংছা সীমান্তে রবিবার রাতে জড়ো হন এসব রোহিঙ্গা। ভোর হতেই নদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালান। কিন্তু বিজিবি সদস্যের বাধার মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করতে না পারলেও সকাল ১০টার দিকে তারা বানের স্রোতের মতো খাল, বিল, জলা, ধানক্ষেত মাড়িয়ে এপারে চলে আসে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা আঞ্জুমানপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, পার্শ্ববর্তী স্কুল-মাদ্রাসায়ও অবস্থান নিয়ে নেয়। কিন্তু দুপুর ১২টার পর থেকে বিজিবির দুই শতাধিক সদস্য তাদের পুনরায় সীমান্তের ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ পাঠিয়ে দেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত না থাকায় গতকাল আসা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানান বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের একজন কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সীমান্তে এবং সীমান্তের জিরো পয়েন্টেই দিনভর চিৎকার, কান্নাকাটিতে ক্ষুধাকাতুর এসব রোহিঙ্গার আকুতিতে ভারি হয় ওঠে বিস্তীর্ণ এলাকার পরিবেশ।

জানা যায়, অনুপ্রবেশ করা অধিকাংশ শিশুই পানীয় জল ও খাদ্যের অভাবে হয়ে পড়েছে অসুস্থ। সীমান্তবর্তী মংডু থানার গ্রামগুলোতে আর কোনো রোহিঙ্গা নেই। তবে রাখাইনের বুছিদং ও রাছিদং থানায় মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাকা রোহিঙ্গাদেরও তাড়িয়ে পুরো রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য করায় তৎপর রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী—এমনটাই জানিয়েছেন সদ্য আসা রোহিঙ্গাদের কয়েকজন। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২৫ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, নতুন করে এ রোহিঙ্গাদের সামলাতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রশাসন। বিজিবি, পুলিশ এমনকি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের সামলাতে এবং ত্রাণ সহায়তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন, ত্রাণ বিতরণসহ সামগ্রিক কাজে জড়িত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা দিতে আসা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষও মানবতার স্বার্থে সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করছেন।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আঞ্জুমানপাড়া ও নো ম্যান্স ল্যান্ড থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কোনো ক্যাম্পে যেতে দেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক লে. আশিকুর রহিম বলেন, ‘আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পাইনি। তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে, নাকি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হবে— এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার পর আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেব। সে পর্যন্ত নতুন আসা এসব রোহিঙ্গাকে এখানেই থাকতে হবে। তবে আমরা খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যাপারে বাধা দিচ্ছি না।’

রোহিঙ্গাদেও ফেরত নিতে বাধ্য হবে মিয়ানমার : মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি গতকাল উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে বলেছেন, আশিয়ানভুক্ত দেশগুলো চাপ সৃষ্টি করলে রোহিঙ্গাদেও ফেরত নিতে বাধ্য হবে মিয়ানমার।  রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ একা নয়। বাংলাদেশে আশ্রিত  রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা ও প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে মালয়েশিয়া।

বেলা ১১টার দিকে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে তিনি রোহিঙ্গাদের অবস্থান ঘুরে দেখেন এবং তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

আবারও নৌকাডুবি, ১১ লাশ উদ্ধার : গতকাল ভোরে  টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ডাঙ্গারচরে মিয়ানমার থেকে আসা নৌকাটি ডুবে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জেলেরা ও কোস্টগার্ড উদ্ধার তৎপরতা শুরু করলে ৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আরও ৩ জনের মরদেহ ভেসে আসে।  টেকনাফ থানার ওসি মাঈনুদ্দিন খান জানান, এ পর্যন্ত্ম ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬ জন নারী, ৪ জন শিশু ও ১ জন পুরুষ। এছাড়া ২১ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। নৌকাটিতে ৫০ জনের মতো রোহিঙ্গা ছিল। বাকিরা এখনো নিখোঁজ। নৌকা ও ট্রলারডুবির ঘটনায় ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত্ম বিভিন্ন সময়ে অন্ত্মত ২০০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় অন্ত্মত আরো দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিখোঁজ হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর