বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নো ম্যান্স ল্যান্ডে লাখ রোহিঙ্গা

সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে সাড়া নেই মিয়ানমারের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কবে যাবেন কেউ জানেন না, নভেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিশ্ব সম্মেলনের ডাক জাতিসংঘের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

নো ম্যান্স ল্যান্ডে লাখ রোহিঙ্গা

মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন প্রায় লাখো রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ (শূন্য রেখায়) সর্বশেষ গত দুই দিনে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়ার শূন্য রেখায় অবস্থান নেয়  আরও অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। তাদের অবস্থান খোলা আকাশের নিচে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা বৃদ্ধ, নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। একদিকে প্রখর রোদ, অন্যদিকে হঠাৎ বৃষ্টিতে অন্তহীন দুর্ভোগের শিকার এসব রোহিঙ্গা। এ ছাড়াও মিয়ানমারের নাইছাদং, কুয়াংছিদং ও পাদংছা সীমান্তে এবং মংডুর সর্বদক্ষিণে নাইক্যনদিয়ায় অবস্থান করছে অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। তারাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শূন্য রেখায় নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা অনাহারে-অর্ধাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অধিকাংশ নারী-শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। ডায়রিয়া, কলেরা, রক্ত ও পানিশূন্যতায় ভুগছেন শূন্য রেখায় সাম্প্রতিক সময়ে আসা রোহিঙ্গারা। আঞ্জুমানপাড়া মসজিদে খোলা মেডিকেল ক্যাম্পে দুই দিনে অন্তত ৩ হাজার অসুস্থ হয়ে পড়া রোগীকে চিকৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। এখানে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন ওয়ার্ল্ড স্বাস্থ্য সংস্থা, এমএসএফ, বাংলাদেশ জনপ্রকৌশল ও স্বাস্থ্য অধিদফতর, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও রেড ক্রিসেন্টসহ দেশি-বিদেশি সংস্থার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এদিকে শাহপরীর দ্বীপে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবিতে এক দম্পতিরই ছয় সন্তানের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের মংডুতে সেখানকার সেনাবাহিনী ও বিজিপির সঙ্গে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটির (আরসা) কতিপয় সদস্যের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপরই শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিজিপির রোহিঙ্গা নিধন, ধর্ষণ ও রোহিঙ্গাপাড়ায় আগুন দেওয়ার এক নজিরবিহীন অভিযান। এরপর ২৫ ও ২৬ আগস্ট বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের কাছে জলপাইতলী ও তুমব্রু সীমান্তের শূন্য রেখায় পালিয়ে এসে নেয় প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে জলপাইতলীতে থাকা প্রায় ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ১২ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ির বড় ছনখোলার শূন্য রেখায় চলে আসে প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা। দুই দিন পর বড় ছনখোলার রোহিঙ্গাদের তিন ভাগে ভাগ করে দুই ভাগ সরিয়ে নেওয়া হয় নাইক্ষ্যংছড়ির আশারতলী ও ফুলতলী সীমান্তের শূন্য রেখায়। একইভাবে গত ১৫ অক্টোবর আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে একসঙ্গে অন্তত অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে বিজিবি প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে শূন্য রেখায় ফিরিয়ে দেয়। বাকি প্রায় ৪০ হাজার এখনো বাংলাদেশ সীমান্তেই অবস্থান গ্রহণ করছে। তাদের কী শূন্য রেখায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে, নাকি উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হবে—এ বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান বিজিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। জানা গেছে, প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বান্দরবানের তুমব্রু বড় ছনখোলা, আশারতলী ও ফুলতলীর শূন্য রেখায় অবস্থান নিলেও তাদের ত্রাণ এবং চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে সেই শুরু থেকেই। এমনকি তাদের তাঁবু তৈরির সরঞ্জামও সরবরাহ করেছে দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো। এখনো প্রতিদিন ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো হচ্ছে এসব শিবিরে। সম্প্রতি বড় ছনখোলার রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় নাইক্ষ্যংছড়ির চাক ঢালায় রেড ক্রিসেন্টের ত্রাণের ট্রাক উল্টে ৯ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এদিকে নাফ নদের তীরে খোলা আকাশের নিচে তীব্র দাপদাহে দ্বিতীয় দিনের মতো মানবেতর জীবনযাপন করছে  রোহিঙ্গারা। গতকালও সকাল থেকে দফায় দফায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায় এসব রোহিঙ্গা। কিন্তু বিজিবি সদস্যের বাধার মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করতে না পেরে তারা আঞ্জুমানপাড়া বিলের বড় আইলেই অবস্থান নেয়। এখানে অসংখ্য নারী-শিশুকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখা যায়। রয়েছেন বেশ কয়েকজন গর্ভবতী মহিলাও। তাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখা গেছে। হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘ লাইনের ভিড় মাড়িয়ে অসুস্থ নারী-শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আঞ্জুমানপাড়া মসজিদে খোলা অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পে আসতে দেখা গেছে। এখানে দায়িত্বরত এমএমএফ হাসপাতালের চিকিৎসক মোখলেসুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অত্যন্ত মানবেতরভাবে কাটছে এবার আসা রোহিঙ্গাদের রাতদিন। ঠাণ্ডা-গরমের মিশেলে এই আবহাওয়ায় সুস্থরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তার ওপর এসব রোহিঙ্গা না খেয়ে আছে ৪/৫ দিন।’

সোমবার সকাল থেকে বিরতিহীনভাবে গত দুদিন এখানে বিভিন্ন চিকিৎসক দল ও সংস্থা আঞ্জুমানপাড়া ও নো ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান নেওয়া অসুস্থ হয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রবিবার থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার নারী-শিশু ও বৃদ্ধকে এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে এরা ডায়রিয়া, হাম, জ্বর, রক্ত ও পানিশূন্যতায় ভুগছে। প্রেগন্যান্সি রোগী আছেন। অনেকের অবস্থা খুব বেশি খারাপ। এ ক্ষেত্রে আমরা বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে বাইরে মেডিকেলে রেফার করছি। এ ছাড়া শিশুদের কলেরার ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে হাম ও পোলিওর টিকা দেওয়া যাচ্ছে না।’

নৌকাডুবিতে এক দম্পতিরই ছয় সন্তানের মৃত্যু :  সোমবার ভোর ৫টা। মিয়ানমারের রাখাইনের ঢংখালী সীমান্ত দিয়ে একটি বাংলাদেশি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন প্রায় ৬০ রোহিঙ্গার একটি দল। ছোট জলযানে  বেশি ভাড়ার লোভে অতিরিক্ত লোক নিয়েছিল নৌকার মাঝি। নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে শাহপরীর দ্বীপ ভিড়তে হঠাৎ বড় ঢেউয়ের আছড়ে ডুবে গেল তরী। সাগরের উত্তাল  ঢেউয়ের সঙ্গে প্রাণপণ যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিল ২২ জন। আর ততক্ষণে ভোরের আলোয় ভেসে এলো আরও ১৩ রোহিঙ্গা নারী-শিশুর নিথর দেহ।

এর মধ্যে  মো.  সেলিম ও খুরশিদা দম্পতিরই ছয় সন্তান। মিয়ানমারের বুসিডং গোদাম পাড়ায় সুখের বসতি ছিল তাদের ঘরে ছিল ৪ কন্যা ও ২ পুত্র সন্তান। সবার বড় মেয়েটার বয়স হয়েছিল ১৬। আর যে সবার ছোট হাফসার বয়স ছিল ৯ মাস। ঘর থেকে বের হয়ে ঢংখালী সীমান্তে এসেছিলেন ১৫ দিন আগে। নৌকা পাচ্ছিলেন না বাংলাদেশে আসতে। অনাহারে-অর্ধাহারে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন কখন নৌকা পাওয়া যাবে। অবশেষে ১৫ অক্টোবর নৌকা পাওয়া গেল, তাও বড় অঙ্কের ভাড়ায়। যাই হোক বাংলাদেশ যেতেই হবে, অন্তত প্রাণে বাঁচা যাবে। পরিবারের আটজনই নৌকা চেপে আসছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু ২২ বছরের সংসার জীবনে পাওয়া অমূল্য রতন ৬ সন্তান সাগর জলে ডুবে এক মুহূর্তেই মৃত্যু হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর কবে কেউ জানেন না : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে সফরের আমন্ত্রণ জানানোর পর আর সাড়া নেই মিয়ানমারের। আগামী ২৩ অক্টোবর সফরের সম্ভাব্য দিনক্ষণ ধরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে গতকাল পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের কোনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সময় ক্ষেপণের উদ্দেশ্যে মিয়ানমার অতীতে নানা রকম কথা বললেও শেষ পর্যন্ত কিছুই করেনি। এবারও একইভাবে আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে লোক দেখানো উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছে মিয়ানমার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমার সরকার আমাদের নিমন্ত্রণ করেছে। আমরা  সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যেদিন তারা তারিখ চূড়ান্ত করে দেবে, সেদিনই আমরা যাব। মিয়ানমার সফরে আলোচ্য বিষয় কী হবে, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পূর্বনির্ধারিত বিষয়ে আমরা কথা বলব। সীমান্ত সংকট, বর্ডার কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে কিছু সমঝোতা স্বাক্ষর হবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে  নেওয়ার বিষয়েও সফরে আলোচনা হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক জোট এশিয়া-ইউরোপ মিটিং বা আসেমের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠক উপলক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগামী মাসে মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন। রাজধানী নেপিডোতে দুই মহাদেশের মন্ত্রীদের অনুষ্ঠিতব্য এ বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু যে প্রাধান্য পাচ্ছে তা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর প্রায় এক মাস পর মিয়ানমারের কোনো প্রতিনিধি বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং তুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এরপর ২ অক্টোবর সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা আসেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দফতরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট  সোয়ে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় আগে ঢাকায় সফরে এসে মিয়ানমারের সেই মন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কথা বলে যান। কিন্তু সেই গ্রুপ গঠনে গত দুই সপ্তাহে কোনো পদক্ষেপের কথা জানানো হয়নি মিয়ানমারের পক্ষ থেকে।  মিয়ানমারের মন্ত্রীর সফরেই আলোচনায় আসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মিয়ানমার যাওয়ার বিষয়টি। মূলত সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমারে আমন্ত্রণ জানানো হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ইস্যু চলে এসেছে সামনে। ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা শুরু হয় ঢাকার কূটনৈতিক মহলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ অক্টোবর মিয়ানমার সফরে যাওয়ার কথা গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।  সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও জানিয়েছিলেন, তিনি সফরে গিয়ে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনে মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে অনুমতি চাইবেন। কিন্তু বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমারের রাজধানী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়ে এখনো কিছু জানানো হয়নি। বাংলাদেশের প্রস্তাব করা চুক্তির খসড়া নিয়েও কোনো সাড়া দেয়নি মিয়ানমার।

নিরাপত্তা ও মাদক সংক্রান্ত ৬ এমওইউ : বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে নিরাপত্তা ও মাদক সংক্রান্ত ছয়টি এমওইউ প্রস্তুত হয়ে আছে বেশ কিছুদিন ধরেই। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে এগুলো স্বাক্ষর হবে বলে দুই দেশ সম্মত হয়েছে আগেই। এই সমঝোতা স্মারকগুলোর খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে কয়েক মাস আগে। এর মধ্যে তিনটিতে স্বাক্ষর করবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাকি তিনটিতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করবেন মিয়ানমারে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তবে এই সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

নভেম্বরে যাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী : আসেম (এশিয়া-ইউরোপ মিটিং) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যোগ দিতে আগামী ১৯ নভেম্বর মিয়ানমার যাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ২০ নভেম্বর  দুই দিনের এই বৈঠক শুরু হবে। বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির পক্ষ থেকে পাঠানো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পত্র গত মাসেই ঢাকা পৌঁছেছে। সোমবার ইউরোপীয় কাউন্সিলে মিয়ানমার নিয়ে গৃহীত একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আসন্ন আসেম বৈঠকের ফাঁকে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতিও আছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। আজ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়সহ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

চাই আন্তর্জাতিক মহলের উদ্যোগ : রোহিঙ্গারা জাতিগত অধিকার নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে নিজ দেশে ফিরতে পারে—এমন একটি পরিবেশ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘে মানবতা বিষয়ক সমন্বয়কারী অফিস অর্থাৎ ইউএন অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ওসিএইচএ), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনার অর্থাৎ ইউএন হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর)। খবর এনআরবি নিউজের। গত সোমবার এই তিন সংস্থার প্রধান এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মহলের আন্তরিক উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি। বিশেষ করে, আসছে ২৩ অক্টোবর এই ইস্যুতে জেনেভায় যে বৈঠক হবে, তার আগেই যেন বিশ্ববিবেক সুস্পষ্ট একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে সক্ষম হয়। রোহিঙ্গারা সবাই যাতে নিরাপদে নিজ বাড়ি-ঘরে ফিরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে সক্ষম হন, এমন একটি স্থায়ী পন্থা অবলম্বনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই মনোযোগী হতে হবে।’উল্লেখ্য, কুয়েত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় ওসিএইচএ, আইওএম এবং ইউএনএইচসিআর-এর সম্মিলিত উদ্যোগে মন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়টি আলোচিত হওয়ার কথা। জাতিসংঘের এই তিন সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, মার্ক লোওকোক এবং উইলিয়াম ল্যাসি সুইং তাদের বিবৃতিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, ‘এ সমস্যা সৃষ্টি মিয়ানমারে, এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারেই।’ বিবৃতিতে বলা হয়, কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের দিন তথা ২৫ আগস্ট থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ ভয়ে নিজ বসতবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। মিয়ানমার বাহিনীর বর্বরোচিত আচরণে রোহিঙ্গারা মানবিক বিপর্যয়ের শিকার। ভিটেমাটি ছেড়ে আসা প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ মানবিকতার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ জন্য সর্বমহলে বাংলাদেশের প্রশংসা উচ্চারিত হচ্ছে। বিকৃতিতে বলা হয়, সীমান্ত খুলে দিয়ে বাংলাদেশ সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে শরণার্থী শিবিরে অবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এটা মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শরণার্থীদের সেবায় দিন-রাত কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ও সেবামূলক সংগঠনগুলো। চোখে না দেখলে এমন মানবিকতার গভীরতা আঁচ করা কঠিন। তবে গৃহত্যাগে বাধ্য হওয়া এসব মানুষের এই বিপদে আরও বেশি সহায়তা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মহলকে উদারচিত্তে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর বিশেষ প্রয়োজন।’ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ দরকার প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে। বাংলাদেশ সরকার সাধ্যমতো চেষ্টা করা সত্ত্বেও অনেক শিবিরেই ঠিকমতো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পৌঁছাচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই বিবৃতিতে। মৌলিক আশ্রয় এবং বহনযোগ্য পানির ট্যাংক, স্যানিটেশন সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনেক জায়গায় স্বেচ্ছাসেবীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এসব বিষয়ে সবার সজাগ থাকা দরকার।

সর্বশেষ খবর