বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৪৮

লাশভর্তি ট্রাঙ্কের পেছনে গোয়েন্দারা

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশভর্তি ট্রাঙ্কের পেছনে গোয়েন্দারা

বিদেশ থেকে দেশে ফিরেই নিখোঁজ হন রুবেল। যাত্রাবাড়ীর এক আত্মীয়র বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি। তার আত্মীয় বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নেন। কোথাও নেই রুবেল। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জেও যাননি। তবে গেল কোথায়? দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন রুবেলের স্ত্রী পপি। ভাবছেন, দুদিন পেরিয়ে গেল। একটি বারের জন্যও মোবাইল ফোন খোলেনি। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। পুলিশকে জানাতে হবে। যাত্রাবাড়ী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। দিনের বেলাতেই বিদেশ ফেরত একজন জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়া হয়ে গেল! কোথাও নেই! তার কোনো শত্রু নেই,  বন্ধুবান্ধব নেই। তবে কীভাবে তার খোঁজ করবে? পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা বেল্লালের মাথায় তখন এসব চিন্তা। কোথা থেকে শুরু করবেন তদন্ত, তা বুঝতে পারছেন না পুলিশের এই তরুণ কর্মকর্তা। রুবেলের স্ত্রী পপির সঙ্গে কথা বলেও তদন্ত কাজে আসবে, এমন কোনো তথ্যই পেলেন না। হতাশ তিনি। ভাবলেন, যাক নিজের মতো করেই অনুসন্ধান করতে হবে। সারারাত ঘুমোতে পারেননি। বেল্লাল খুব ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। আগের দিন রিকুইজিশন দিয়ে রাখা মোবাইল ফোনের কল লিস্টটাও হাতে নিলেন। তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে জানতে পারলেন, রুবেলের সর্বশেষ অবস্থান। পূর্ব রামপুরা। এই এলাকাকেই টার্গেট করলেন তিনি। এই স্থানেই রুবেলের ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। বেলালের মনটা আজ ভালো। এলাকার নামটি জানতে পেরেছে। এখান থেকেই অনেক দূর যাওয়া যাবে। কিন্তু পূর্ব রামপুরায় আছে শত শত বাসা। কোন বাসায় যাবেন তিনি? তা ছাড়া কার বাসায় ছিল রুবেল, তা অজানা। তবে কীভাবে কী করবে? এমন চিন্তায় পুলিশ কর্মকর্তার মাথাটা আরও খারাপ হতে তাকে। তাহলে কী নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে না? নানা চিন্তায় হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি খেলল। ভাবল, রুবেলের বাড়ি নেত্রকোনা। খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে, নেত্রকোনার কোনো ভাড়াটিয়া আছে কিনা। এতে করে তল্লাশির জায়গাটা নির্দিষ্ট করা গেল। এক বাসার পর আরেক বাসা, এই বাসার পর ওই বাসা। এমন করতে করতে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আসে রাত। শরীর চলে না বেল্লালের। বাসায় ফিরে যান তিনি। ভাবছেন, পরদিন হবেই হবে। সেই মতে আবারও তল্লাশি। বাসায় বাসায়। সেদিনও হলো না। একে একে চার দিন পেরিয়ে গেল। কিন্তু কোনো সুরাহাই হচ্ছে না। প্রচণ্ড জিদ চেপে গেল পুলিশ কর্মকর্তা বেল্লালের। খোঁজ না নিয়ে তিনি আর বাসায় ফিরবেন না। এমন এক দৃঢ়তা মনে নিয়ে পাঁচ দিনের দিন আবারও খুব ভোরেই বেরিয়ে গেলেন। প্রথম বাসা, দ্বিতীয় বাসা, তৃতীয় বাসাতেই কিছু একটা মিলেছে বলে মনে হলো তার। তার চোখে মুখে খুশির আভা। তিনি জানতে পারলেন, পূর্ব রামপুরার ৭৮/২৪ নম্বর বাসার ভাড়াটিয়ার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। রুবেলের বাড়িও মোহনগঞ্জ। কেমন যেন যোগসূত্রের গন্ধ পাচ্ছেন বেল্লাল। দারোয়ানের কাছে শুনেই তিনি ভিতরে ঢুকতে যাবেন, তখনই দারোয়ানের বাধা। বলে, ওরা নেই। কবে আসবে বলে যায়নি। বাইরে গেছে আর ফিরেনি—কথার এই লাইনটা শুনে পুলিশ কর্মকর্তার মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা থাকলেও তা হলো না। বরং তিনি ভাবছেন, না পাওয়া যাক, এখানেও ঘটনা ঘটতে পারে। এটা নিশ্চিত হওয়া গেলেই তো অনেক দূর গেল। এরপর আসামিরা যেখানেই থাকুক না কেন খুঁজে বের করাটা তেমন কোনো কঠিন বিষয় নয়। আগে ঘটনাটা ডিটেক্ট করতে হবে। এমনসব ভাবনা নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা। দারোয়ানের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বাড়িওয়ালাকে ডেকে আনতে বলে। বাড়িওয়ালা চলে আসে। তিনি পুলিশকে জানান, বেশ কয়েকদিন আগেই তারা বাসা থেকে কিছু মালামাল নিয়ে গ্রামে গেছে। কবে আসবে কিছু বলেনি। কী নিয়ে গেছে? পুলিশের এই কর্মকর্তার প্রশ্নে বাড়িওয়ালা জানায়, আলমারি, শোকেস এবং একটি ট্রাঙ্ক ছিল তাদের সঙ্গে। পুলিশের এই কর্মকর্তার সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে। উত্তেজনায় তিনি দেরি করতে পারছেন না। তিনি ওই ফ্ল্যাটের ভিতর ঢোকার অনুমতি চান বাড়িওয়ালার কাছে। বাড়িওয়ালা ঘটনা শুনে দরজার তালা ভাঙে। পুলিশ কর্মকর্তা ভিতরে ঢুকে। দুরুমের ওই ফ্ল্যাটের চারপাশ ভালো করে দেখতে থাকেন। খেয়াল করে দেখেন, এমন কিছু মালামাল নিয়ে গেছে, যেসব জিনিস নিত্য প্রয়োজনীয়। থালা, বাসন, পাতিল—এসব উল্লেখযোগ্য। চৌকস পুলিশ কর্মকর্তার মাথায় এ বিষয়টি খটকা লাগে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেন নিবে? কদিনের জন্য তারা গেছে। কোথায় গেছে? এমন প্রশ্নের পর প্রশ্ন তার মাথায়। পাশের অপর এক ভাড়াটিয়ার ফ্ল্যাটে যান বেলাল। মধ্য বয়স্ক একজন মহিলার সঙ্গে তিনি গল্প জুড়ে দেন। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে তিনি কথা বলেন। কথার মধ্যেই তদন্তে সহায়ক তথ্য বের করে নেন বেলাল। বেলাল জানতে পারেন, সন্দেহভাজন ভাড়াটিয়ার নাম ঝুমা। তার স্বামী মোজাম্মেল। তারা মালামাল নিয়ে দেশের বাড়ি নেত্রকোনায় চলে গেছেন। আসতে দেরি হবে। তাদের সঙ্গে যে ট্রাঙ্ক ছিল, তা যাওয়ার একদিন আগে কিনেছে বলেও জানিয়ে দেয় সেই মহিলা। সন্দেহ আরও তীব্র হতে থাকে বেল্লালের। বেল্লাল ভাবছে, অঙ্কের নামতার মতো সব যেন কেমন করে মিলে যাচ্ছে। কেন তারা গ্রামে গেল? বেল্লালের এমন প্রশ্নে বয়স্ক ওই মহিলা জানান, তাদের এক আত্মীয় নাকি অসুস্থ ছিল। মারা গেছে। লাশ নিয়ে যেতে হবে গ্রামের বাড়ি। আর যেন দেরি করতে পারছেন না পুলিশের কর্মকর্তা বেল্লাল। তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এবার নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধানে ছুটতে শুরু করল পুলিশের দল। তারা প্রথমেই গেল ঝুমাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। ঝুমাদের বাড়িতে যেয়ে পুলিশ দেখতে পায় ঢাকা থেকে নিয়ে আসা সেই আলমারি আর শোকেস। কিন্তু ট্রাঙ্ক নেই। পুলিশের সন্দেহ যেন সঠিক দিকেই যাচ্ছে। ঝুমা নেই বাড়িতে। পাশের গ্রামে এবার ঝুমার স্বামী মোজাম্মেলের বাড়িতে অভিযান। সেখানেও তারা নেই। মোজাম্মেলদের বাড়ির পেছনের ধানখেতে এক রাতে মোজাম্মেলকে দেখেছেন—এমন তথ্যও পেয়ে যায় পুলিশ। ধানখেতে তল্লাশি। এক পর্যায়ে পুলিশ ধানখেতের ভিতর থেকে পুঁতে রাখা লাশ উদ্ধার করে। ট্রাঙ্কের সূত্র ধরে এভাবেই নিখোঁজ রুবেলের লাশ মিলে। এবার খুনি ধরার পালা। পুলিশ খবর পায় ঝুমা আর তার স্বামী মোজাম্মেল আছে সিলেটে। পুলিশ খবর পেয়ে সিলেটে যায়। একে একে পাঁচটি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পুলিশ ট্রেকিং করে জানতে পারে, ঝুমা সিলেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার পথ নারায়ণগঞ্জের দিকে। পুলিশ পরদিন ভোরে সিলেটের একটি হোটেলে অভিযান চালিয়ে মোজাম্মেলকে গ্রেফতার করে। তাকে নিয়েই নারায়ণগঞ্জ। গ্রেফতার হয় ঝুমা। তাদের তথ্যে ঢাকা থেকে গ্রেফতার হয় ঝুমার ভাই জাকিরুল। এর পরের গল্প মানুষরূপী হায়েনাদের।  এই তিনজনই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তারা এখন আছে কারাগারে। প্রবাসী রুবেলের কাছ থেকে নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নিতেই তারা হত্যা করে। ঝুমা সম্পর্কে চাচা হন রুবেল। পুলিশের জেরার মুখে ঝুমা জানায়, ‘চাচা খাটে শুইয়া ছিল, আমি ফ্লোরে বইসা আদা-রসুন বাটতেছিলাম। কোনো কিছু চিন্তা না কইরা হাতের পুঁতা দিয়া ওনার মাথায় বারি মারি। বুঝতে পারি নাই মইরা যাইব। অনেক রক্ত দেইখ্যা পরথম ঘাবরাইয়া গেছিলাম। পরে ঠাণ্ডা মাথায় বাজার থেইক্কা ২৫০০ টাকা দিয়া একটা ট্রাঙ্ক কিন্যা আনি। লাশটারে পরথম পলিথিনে প্যাঁচাইয়া ট্রাঙ্কে ভরতে চাইছিলাম। কিন্তু লম্বা শরীরডা ট্রাঙ্কে না  ঢোকায় বঁটি দিয়া হাত-পা-মাথা টুকরা টুকরা কইরা কাটি। এরপর পলিথিনে প্যাঁচাইয়া ট্রাঙ্কে লাশ ঢুকাইয়া বইস্যা থাকি। বিছানার কাপড় দিয়া রক্ত মুইচ্ছা হেইডা আর আমার জামা-কাপড় ওই ট্রাঙ্কেই রাহি। রাইত সাড়ে আটটার দিকে হেয় (স্বামী মোজাম্মেল হক) আইলে পুরা কাহিনী খুইল্লা কই। চাচার লগে থাকা টাকা, সোনা হেয়  নেয়। লাশসহ সারা রাইত আমরা বইস্যা থাকি। পরেরদিন একটা পিকআপে কইরা লাশভর্তি ট্রাঙ্কডারে আমরা নেত্রকোনা লইয়া যাই। হেইখানে নিয়া লাশটারে মাটিতে পুঁইত্তা ফেলি। পুলিশ জানায়, চলতি বছরের ১৯ জুলাই নিখোঁজ হয় রুবেল। ২১ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি হয়। ২ আগস্ট রুবেলের অর্ধগলিত লাশ ধানখেত থেকে উদ্ধার করা হয়।

সর্বশেষ খবর