শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রস্তাবের শেষ নেই ইসিতে

আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি, ৫৩১ সুপারিশ, যাচাই-বাছাইয়ে সতর্ক নির্বাচন কমিশন

গোলাম রাব্বানী

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে প্রস্তাবের শেষ নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। নিবন্ধিত ৪০টি দলের সংলাপে ইসির টেবিলে রয়েছে ৫৩১টি সুপারিশ। ২৪ আগস্ট শুরু হওয়া সংলাপ গতকাল শেষ হয়েছে।

সংলাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি সুপারিশ তুলে ধরেছে ইসির কাছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল বা সহায়ক সরকারের নামে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে কয়েকটি দল প্রস্তাব রাখলেও অধিকাংশ দলের প্রস্তাব অভিন্ন। তবে প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাইয়ে সতর্ক থাকবে ইসি। এ ক্ষেত্রে ইসির আওতাধীন প্রস্তাবগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিলেও এখতিয়ারে নেই এমন প্রস্তাব সরকারের কাছে প্রতিবেদন আকারে পাঠাবে তারা।

আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালুর পক্ষে মত দিয়েছে। এ ছাড়া সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও সেনা মোতায়েনের বিরোধিতা করে দলটি ১১ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে ইসির কাছে। যেহেতু দশম সংসদ নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে হয়েছে, আর আগামী নির্বাচনও বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই হবে, তাই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কোনো সুপারিশ ইসির কাছে করেনি দলটি। অন্যদিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে ‘সহায়ক সরকার’-এর অধীনে ভোটের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। ভোটের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন, ২০০৮ সালের আগের সংসদীয় আসন সীমানা ফিরিয়ে আনা, ইভিএম চালু না করা, জরুরি অবস্থার সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দলীয় চেয়ারপারসনসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের সব মামলা প্রত্যাহারসহ ২০টি সুপারিশ দিয়েছে দলটি। সংলাপের প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইভিএম চালু, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ না করা ও সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে প্রস্তাব এসেছে ইসির কাছে। দলগুলো নির্বাচনকালীন সরকার ও সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার মতো প্রস্তাব ইসির কাছে রেখেছে।

পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসির এখতিয়ারের মধ্যে থাকা অভিন্ন সুপারিশ রয়েছে বেশি।

৪০টি দলের মধ্যে অন্তত ১৯টি দল সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে, এর মধ্যে অনেকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে বা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে রাখার সুপারিশ করেছে। অন্তত ১৩টি দল সংসদ ভেঙে ভোটের সুপারিশ করেছে; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোটের প্রস্তাবও অন্তত ১০ দলের। ইভিএম চালুর পক্ষে মত দিয়েছে আওয়ামী লীগসহ ৮ দল। আর ইভিএম চালুর বিপক্ষে মত দিয়েছে বিএনপিসহ ১০ দল। তিনটি দল সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল নিয়েও সরকার গঠনের কথা বলেছে। আবার নবম সংসদের প্রতিনিধিও রাখার প্রস্তাব তুলছে কেউ কেউ।

ব্যতিক্রম কিছু প্রস্তাব : নির্বাচনকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা বাতিল করে তিন মাসের অবকাশকালীন ছুটি দেওয়া, একই পোস্টারে সব প্রার্থীর পরিচয় ও প্রতীক, একই মঞ্চে প্রার্থীদের বিতর্ক আয়োজন, তিন ধাপে ৩০০ আসনে ভোট, নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্রে সিসি (ক্লোজ সার্কিট) ক্যামেরা স্থাপন, সংরক্ষিত নারী আসন ১০০-তে উন্নীতকরণ, সংরক্ষিত নারী আসন বাতিল ও ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের শপথ পাঠ করানোসহ ব্যতিক্রম কিছু প্রস্তাবও আছে। আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবের বাইরে কৌতুক করে নির্বাচন কমিশনকে এক নেতা বলেছেন— টেনশনে থাকলে বাংলা সিনেমা দেখবেন।

স্বস্তি ইসিতে : ধারাবাহিকভাবে ৪০টি নিবন্ধিত দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ করতে পেরে স্বস্তিতে নির্বাচন কমিশন। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে নতুন কমিশন গঠনের পর জুলাই থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ শুরু করে। নবম ও দশম সংসদ ঘিরে বিগত দুই কমিশনের সংলাপের অভিজ্ঞতা ‘সুখকর’ না হওয়ায় কে এম নূরুল হুদা কমিশনও এ নিয়ে ‘চিন্তায়’ ছিল। তবে ২৪ আগস্ট থেকে গতকাল ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৪০টি দলের সঙ্গেই ‘সুচারু ও সফলভাবে’ সংলাপ সম্পন্ন করতে পেরেছেন বলে বর্তমান ইসি ‘স্বস্তি’ বোধ করছে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। গতকাল তিনি বলেন, ‘আমরা বেশ সফলভাবে রাজনৈতিক দলের সংলাপ শেষ করেছি। সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন। আমরাও সহায়তা পেয়েছি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের ‘ভূয়সী প্রশংসা’ নিয়ে সাময়িক ‘আলোচনার ঝড়’ উঠলেও তা কেটে যাওয়ায় স্বস্তি কমিশনেও।

আওয়ামী লীগের প্রস্তাব : আওয়ামী লীগের সুপারিশের মধ্যে আরও আছে, নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে নির্বাচনী আইন-বিধির কঠোর প্রয়োগ; নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিতদের দায়িত্বে অবহেলা ও অপেশাদার আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা; যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগ; দলীয় প্রার্থী চূড়ান্তে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে আগ্রহীদের বাছাই; দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতাবিধান; ভোটের দিন গণমাধ্যমকর্মীদের নির্বাচনী আইন-বিধি অনুসরণ এবং উপযুক্ত পরিচয়পত্র প্রদান এবং দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের ভোটের তিন দিন আগে এনআইডি ও ছবিসহ তালিকা দেওয়া।

বিএনপির প্রস্তাব : বিএনপির সুপারিশের মধ্যে আরও আছে—  জরুরি অবস্থার সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দলীয় চেয়ারপারসনসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহারসহ ২০টি সুপারিশ দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া গুম-খুন-হয়রানি ও ভীতি সঞ্চার বন্ধ করা, এখন থেকে সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অধিকার নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের কার্যকর সংলাপ অনুষ্ঠানে ইসিকে উদ্যোগ গ্রহণ, নির্বাচনের সাত দিন আগে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রসহ নির্বাচনী আসনে সেনা মোতায়েন, আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্তকরণ, আরপিওর নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আইনকানুন-বিধিবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধন, প্রশাসনকে দলীয়মুক্তকরণ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, নির্বাচনকালীন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব সিদ্ধান্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা একক কোনো কমিশনারের সিদ্ধান্তে নয় কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রহণ, নির্বাচন-পূর্ব সময়ের শুরুতে সব মেট্রোপলিট কমিশনার, ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি পরিবর্তন করা, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার প্রদান, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকাভুক্ত করা, ভোটার যোগ্য কারাবন্দীদের ভোটার তালিকাভুক্তি করা, মনোনয়নপত্র ‘অন লাইনে’ দাখিলের বিধান প্রবর্তন, ভোট গ্রহণ শেষে সব পোলিং এজেন্টের উপস্থিতিতে ভোট গণনা করা, প্রিসাইডিং অফিসার কর্তৃক ভোট গণনার স্বাক্ষরিত বিবরণী উপস্থিত প্রত্যেক এজেন্টকে প্রদান না করে ভোটকেন্দ্র ত্যাগ না করাসহ ২০ প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।

এরশাদের আট প্রস্তাব : নির্দিষ্ট সময়ে সংসদ ভেঙে দিয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের প্রতিনিধি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে বর্তমানের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া নির্বাচনের সময়ে দেশজুড়ে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, ভোটারের ভিত্তিতে সীমানা পুনর্নির্ধারণসহ আট দফা প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। এ ছাড়া নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণার পর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনে কোনো বিতর্কিত কর্মকর্তাকে দায়িত্বে রাখা যাবে না। নির্বাচনী ব্যয় সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করে সব খরচ তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করতে হবে।

অন্যান্য দলের প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে : সব দলের অংশগ্রহণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত; প্রচারে সরকারি সুবিধা বাদ; কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন; প্রবাসীদের ভোটাধিকার; অনলাইনে মনোনয়ন জমা; গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের তৎপরতা বন্ধ; স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় ১% সমর্থন তালিকা বাতিল; স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ রাখা; নিবন্ধিত দলকে রাষ্ট্রীয় অনুদান, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত ব্যক্তি, মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করা; ফৌজদারি দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া; নির্বাচনী বিরোধ তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করা, নৈতিক স্খলনের অভিযোগে দণ্ডিতদের দুই বছর পর সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ বাতিল করা, যেসব দল ৩০ এর বেশি প্রার্থী মনোনয়ন দেবে সেসব দলকে বেতার ও টিভিসহ সরকারি প্রচারমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সুযোগ দেওয়া। এনবিআর ও দুদকের মাধ্যমে হলাফনামার তথ্য যাচাইসহ ৫৩১টি প্রস্তাব এসেছে ইসির কাছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর