শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ফটো দেখানো নিয়ে আইনজীবীদের মারামারি

তিন শর্তে জামিন খালেদা জিয়ার বললেন, আমি কার কাছে যাব

অনুমতি নিয়ে বিদেশ যেতে পারবেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

তিন শর্তে জামিন খালেদা জিয়ার বললেন, আমি কার কাছে যাব

বিশেষ আদালত থেকে খালেদা জিয়া চলে যাওয়ার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে হাতাহাতিতে জড়ান বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর বকশীবাজার আলিয়া মাদ্রাসায় স্থাপিত ঢাকার অস্থায়ী ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান বিএনপি চেয়ারপারসন। শুনানি শেষে বিচারক এক লাখ টাকা মুচলেকায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। এ সময় আদালত জানায়, অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে পারবেন খালেদা জিয়া। আগামী ২৬ অক্টোবর উল্লিখিত দুই মামলার শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করে আদালত। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আমি নিজেকে খুবই সামান্য একজন মানুষ মনে করি। এই দেশ ও জাতির স্বার্থে আমি জীবনের সীমিত শক্তি, মেধা ও জ্ঞানকে উৎসর্গ করে দিয়েছি। তিনি বলেন, সরকারের হস্তক্ষেপে বিচার বিভাগ দেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। এ সময় তিনি নিজের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বানোয়াট ও মিথ্যা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে এতিমদের জন্য আসা একটি টাকাও তছরুপ বা অপচয় হয়নি। সমুদয় টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। হয়রানি ও হেনস্তার জন্যই এ মামলা দেওয়া হয়েছে। আদালতের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি কার কাছে যাব? আমি আদালতের প্রতি বিশ্বাস রাখতে চাই। গতকাল আদালত এ মামলার অপর দুই আসামি কাজী সেলিমুল হক এবং শরীফ উদ্দীনকেও জামিন দিয়েছে। বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার পক্ষে আদালতে জামিন আবেদন করেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বেগম জিয়ার পক্ষে জামিন চান। জামিন আবেদন দাখিল করে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার আদালতকে বলেন, খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তিনি আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই দুটি মামলায় তিনি সহযোগিতা করে আসছেন। তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। গতকাল (বুধবার) রাতে তিনি বাসায় ফিরেছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) সকালেই তিনি আদালতে এসেছেন আত্মসমর্পণের জন্য। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কারণেই জামিন চাইতে এসেছেন। তিনি আদালতের নির্দেশ মান্য করেই চলেন। তাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী জামিন কামনা করছেন।

এ সময় বেগম জিয়ার পক্ষে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, আবদুর রাজ্জাক খান, নিতাই রায় চৌধুরী, এ জে মোহাম্মদ আলী প্রমুখ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া আদালতে দলীয় নেতাদের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, আবদুস সালাম, জয়নুল আবদিন ফারুক, আমানউল্লাহ আমান, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জামিনের বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এর আগেও দুবার খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল করা হয়েছিল। তিনি জামিনের শর্ত লঙ্ঘন করেছেন। তিনি বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং তার জামিনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাচ্ছি। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাসা থেকে আদালতের উদ্দেশ্যে বের হন। বেগম খালেদা জিয়া আদালতকে অবহিত করে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ছিল। ক্ষমতায় আসার পর সেই মামলাগুলো একে একে প্রত্যাহার ও নিষ্পত্তি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, শাসক দলের মন্ত্রীরা বিচারাধীন মামলার বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়ে বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে বানোয়াট ও মিথ্যা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের নামে এতিমখানা স্থাপনের জন্য বিদেশ থেকে যে অনুদান এসেছিল, তা এতিমখানার কল্যাণেই ব্যয় হয়েছে। সেই ব্যয়ের পর বাকি অংশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। ব্যাংকের সুদ যুক্ত হয়ে সেই টাকা এখন অনেক বেড়েছে। খালেদা জিয়া আরও বলেন, এই মামলায় হয়রানির জন্য তার ব্যক্তিগত জীবন ব্যাহত হচ্ছে। মামলায় দুদক যে অভিযোগ এনেছে তা-ও স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। এটি দুদকের আইনের কর্তৃত্ব ও আওতার বাইরে। দীর্ঘ এক ঘণ্টার বক্তৃতায় তিনি বলেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুদক একটি (মানি লন্ডারিং) মামলা করে। ওই মামলায় একজন বিচারক তাকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। পরবর্তীতে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু তৎপরতা চালানো হয়। তিনি আত্মরক্ষার জন্য সপরিবারে বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেই বিচারক নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এসব ঘটনা দেশে অহরহই ঘটছে।

বিচারকের উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, মাননীয় বিচারক, আপনি যেখানে বসে বিচার করছেন, যে এজলাসে বসেছেন, এটা  কোনো আদালতের প্রাঙ্গণ নয়। মাননীয় আদালত, মনে পড়ছে ফখরুদ্দীন ও মইন উদ্দীনের অসাংবিধানিক শাসনামলের কথা। তখন দেশের নেতা- নেত্রীদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে কোর্ট-কাচারির বাইরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ আদালত বসানো হয়। সেখানে বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। এটা করা হয়েছে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে। কারণ ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্যই ছিল এটা। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের মামলার বিচারকাজ যেখানে করা হয়েছে, সেখানে আমার মামলার বিচার কেন করা হচ্ছে? আমার বিরুদ্ধে আরও যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলো অন্য আদালতে বিচারাধীন হলেও এ দুটি মামলা এখানে আনা হলো কেন? এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য হলো বিচারের নামে আমাকে জনসম্মুখে হেনস্তা ও অপমান করা। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আমার মামলার কাজ এখানে চালাচ্ছে। এ ধরনের আচরণকে স্বাধীন বিচারের অন্তরায় উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আমাকে এভাবে হেনস্তা ও অসম্মান করার প্রতিকার কোথায় পাব? নিম্ন আদালতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকায় বিচারকরা যথাযথভাবে বিচার করতে পারছেন না। বকশীবাজার কোর্ট ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দীনের শাসনামলের কোর্টের মতো। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের বিরোধ প্রকাশ্য হয়েছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বেগম জিয়া বলেন, বিচার বিভাগের হাত-পা বাঁধা। আর এ কারণে আমার মামলায় ন্যায়বিচার হবে কিনা তা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় আছে। এসব মামলায় বিচারের নামে আমি হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হচ্ছি। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। আদালত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সকাল ১০টা ২৮ মিনিটে বেগম জিয়া তার গুলশানের বাসা থেকে আদালতের উদ্দেশ্যে বের হন এবং বেলা সোয়া ১১টার দিকে সেখানে পৌঁছেন। ১২ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তিন মাস পর যুক্তরাজ্য থেকে গত বুধবার দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন। বিদেশে থাকতেই ঢাকা ও কুমিল্লায় নাশকতা, দুর্নীতি ও মানহানির পাঁচটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। হঠাৎ করে দুই দিনের মধ্যে এসব মামলায় একটার পর একটা আদালতের পরোয়ানা জারির প্রেক্ষাপটে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। গ্রেফতারের আশঙ্কাও করেন অনেকে।

বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ধস্তাধস্তি : গণমাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে। গতকাল দুপুর সোয়া ১টার দিকে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস প্রাঙ্গণে এ ঘটনা ঘটে।

এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসন সে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিন নেন। বেগম খালেদা জিয়া আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই সাংবাদিকদের সামনে শুনানির কার্যক্রম তুলে ধরতে তার দুই আইনজীবীর মধ্যে প্রথমে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী জুনিয়র আইনজীবী মো. পারভেজ  ঘটনার সত্যতা স্বীকার জানান। জানা যায়, অপেক্ষমাণ টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা আইনজীবীদের মতামত চাইতে গেলে কে কথা বলবেন এ নিয়ে উভয়ের অ্যাডভোকেট খোরশেদ ও অ্যাডভোকেট মামুনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি হয়। পরে উপস্থিত অন্যান্য আইনজীবীদের মধ্যেও  উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৫ মিনিট ধরে এই হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় তাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তাদের চিৎকারে আদালত থেকে অন্য আইনজীবী ও পুলিশ সদস্যরা এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

সর্বশেষ খবর