শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
স্মৃতি-বিস্মৃতির কথা

অমিত শক্তি তারুণ্যের

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

অমিত শক্তি তারুণ্যের

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সংবাদপত্রের চেয়ে কম শক্তিশালী, তা বলা যাবে না।

একজন ক্ষুদ্র লেখকও ছয়টি মহাদেশ থেকে লেখার ফিডব্যাক পাচ্ছি। সংখ্যাটি ব্যাপক, তা নয়। খুব কমই বা কী করে বলি, যখন তা লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ধরা যাক, বাংলাদেশের কোনো একটি কাগজ ব্যবসা করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল মূল ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে, কারণ সেটি পাওয়া যাচ্ছে কম্পিউটারে, মোবাইলে। ইতিপূর্বে কিনতাম সংগ্রহের জন্যে, এখন পেনড্রাইভে কয়েক শত লেখা সহজেই সংরক্ষণ করা সম্ভব। পৃথিবী সঙ্কুচিত, সময়ের মূল্য বুঝতে শিখছি, একটি ঘণ্টায় অনেক কাজ করতে পারছি একসঙ্গে। এটাই অগ্রগতি। আজ বলতে চলেছি নতুন নাগরিকদের সঙ্গে আমার কিঞ্চিত যোগাযোগের ফলাফল। একজন তরুণ আমেরিকায় ছিল ষোল বছর, লেখাপড়া সেখানেই। ইংরেজির অ্যাকেসন্ট আমেরিকানদের মতোই, বাংলাও খাসা। বললেন, আব্বাসী চাচা, বাঙালিদের জন্য পৃথিবী উন্মুক্ত, প্রয়োজন : স্মার্টনেস। চাকরি খোঁজার দরকার নেই। চাকরি এসে পায়ের কাছে উপচে পড়ছে। কীভাবে? বলল, যা পড়াশোনা করেছি তাতে এখন পর্যন্ত আমার কাছে পাঁচটি চাকরি, তার একটিও নেইনি। প্রথম ব্যবসাতেই সফল। আমেরিকা তাদের জন্য, যারা ‘এন্ট্রিপ্রিনিওর’, যারা প্রথম দিনের কলাম্বাসের মতোই সবকিছুতেই খুঁজে পাবে ‘সুযোগ’। It is a land of opportunities for the right people। গত মাসে রোবটিক সার্জন ড. আতিকুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি আমেরিকায় তিন হাজার বাঙালি ডাক্তার, কলকাতার ডাক্তাররা অনেক পেছনে। আমাদের ডাক্তাররা ভালো, পরিশ্রমী এবং সমাজে জায়গা করে নিয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা : ট্যাক্সি ড্রাইভার, দোকান কর্মচারী। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। আমরা লেখাপড়া শিখে চলেছি। জামাই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। জীবনে দ্বিতীয় হয়নি। এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় সর্বোচ্চ বেতনভুক অধ্যাপকের চেয়ে তার মাইনে তিন ডাবল। বাড়ি-গাড়ি তো আছেই। কীভাবে? জামাইকে জিজ্ঞেস করলাম? হাসল। বলল, আব্বু, এসবই আমার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অগাধ ভালোবাসার ফল। পর পর তিন বছর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বলেছে, ড. খালেদ না থাকলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব না। এটাই অর্জন। অর্থাৎ ভালোবাসা দিয়েই সবচেয়ে ভালো জায়গাটি অধিকার করা সম্ভব, ডিগ্রি দিয়ে নয়। ডিগ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর একটি সনদ মাত্র। ডক্টরেট করিনি, তা সত্ত্বেও আমেরিকায় জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পেলাম। প্রথম দিনেই ছাত্র-ছাত্রীরা ভক্ত হয়ে গেল, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। শত ছাত্র-ছাত্রী, টগবগে তরুণ। পৃথিবীকে আগ বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। নতুন পৃথিবীর নতুন নাগরিক তারা। এই অধমের মধ্যেই হয়তো খুঁজে পেল একটি নতুন জগৎ। সুফি জগৎ, জালালউদ্দিন রুমির জগৎ। বলল : এই তো আমাদের ভালোবাসার লোককে খুঁজে পেয়েছি। ওই দেখা যায় ‘রুমির অলৌকিক বাগান’। ওখানে আমরা যেতে চাই তোমার হাত ধরে। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। অন্ধকার পৃথিবীর দুটি মেয়ে বলল, আপনার কাছে মুসলমান হতে চাই। বললাম, সেটি হবে না। পড়াতে এসেছি, মুসলমান বানাতে নয়। জালালউদ্দিন রুমি তাদের মনকে এমনই আচ্ছন্ন করে ফেলল যে, পরে শুনেছি ওরা কোনো মৌলবির কাছে গিয়ে মুসলমান হয়েছে। অথচ ওদের একজনের বাবা খ্রিস্টান, আরেকজনের বাবা ইহুদি। মার্কিন তরুণ বাল্যকাল থেকেই ভালোবাসা বঞ্চিত। যারা ভালোবাসা দেবে, তাদের কাছেই করবে আত্মসমর্পণ।

বহু বছর আগে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার স্মৃতি জাগরিত হয়েছে। সঙ্গে স্ত্রী আসমা ও সস্ত্রীক ড. এনামুল হক। ড. জুলেখা আমার সহপাঠিনী ও বান্ধবী। সে আজ নেই। দুটি দিন কাটল আনন্দে। দুয়েকজন ছাত্রকে নিভৃতে জিজ্ঞেস করলাম, শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছ, রবীন্দ্র অভিসারী? বলল : না। রবীন্দ্রনাথ নয়। চাকরির প্রয়োজন, অন্য কোথাও ভর্তি হতে পারিনি। তাই এখানে...। বুঝুন ঠেলা। চলছিল বসন্ত উৎসব। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো শুনতে ছেলেগুলো সেখানে যায়নি। আমি গেলাম। ওদের সঙ্গে গাইলাম : ‘ওরে ভাই, আজ ফাগুন এসেছে বনে বনে’, তারপর; ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। সবাই যে এ রকম তা নয়। চিত্রপট পাল্টে গেছে। আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে, গান, বক্তৃতা। একবাক্যে স্বীকৃতি : পৃথিবীতে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালি জাতি আমরাই। হিন্দু-মুসলমান বুঝি না। আছে পতাকা, আছে জাতীয় সংগীত : ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। আমাদের উপরে ওঠা কেউ ঠেকাতে পারবে না। কোনো দল অথবা গোষ্ঠী নয়। গণতন্ত্র মানি, একনায়কত্ব নয়। ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’। এটাই তারুণ্য। তারুণ্যের অমিত শক্তি। শনিবার সিলেট থেকে এলাম। বিরাট সম্মেলন নতুন রোটারিয়ানদের। রোটারি ক্লাব অব সিলেট প্রিমিয়ার। ৩৪ জন সদস্য। সবাই তরুণ। আমার বক্তৃতা শুনতে এসেছে। চোখে দেখেনি, গানও শোনেনি। জিজ্ঞেস করলাম, গান শুনবে, না বক্তৃতা শুনবে? ওরা বলল, আপনার মিলাদ শুনব, অর্থাৎ আল্লাহ রসুলের কথা। জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে চেন? কলকাতার মেয়র ছিলেন। বাংলার একজন মেধাবী ব্যক্তিত্ব, যাকে আমরা ভুলে গেছি। ওরাও চিনতে পারল না। আব্বাসউদ্দিন, একলিমুর রেজা চৌধুরী, নজরুল? কেউ কেউ ঘাড় নাড়ল, অর্থাৎ অল্প অল্প চেনে। বললাম, মাত্র আশি বছর আগে এরা তিনজনই সুরমা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছিলেন। আব্বাসউদ্দিন গেয়েছিলেন সেই সুন্দর গানটি যা তার বইতে সুন্দর করে লেখা আছে। গানটি হলো : ‘এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবাণী’। আব্বাসউদ্দিনকে মনে রেখেছ? তার জন্য একটা রাস্তার নামকরণ? একটা স্কুলের? একটা পাঠশালার? উত্তর : না। তা হলে তোমরা কেমন বাঙালি, যারা সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে চেন না, আব্বাসউদ্দিনকে চেন না, হাসন রাজা চেন না, একলিমুর রেজা চৌধুরীকে চেন না? তাদের বেশ কয়েকটি গানও শোনালাম, যা তারা রেডিও, টেলিভিশনে শোনে না বছরের পর বছর। মিডিয়া অধিকৃত। ওরা আমাদের চেনে না। দেড় ঘণ্টা কেমন করে চলে গেল, কেউ টের পেল না। বুঝলাম ওরা আমাকে ভালোবাসে। সেলফি তুলতে এগিয়ে এলো, ফুল দিল, ভালোবাসা দিল। উপলব্ধি করলাম তারুণ্যের অমিত শক্তি। লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর