শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

খবর নেই ঢাকার খাল উদ্ধারের

সাঈদুর রহমান রিমন

খবর নেই ঢাকার খাল উদ্ধারের

রাজধানীর খিলগাঁও-বাসাবো খালের করুণ হাল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর বেদখল হওয়া খাল উদ্ধারে কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতি বছর যেসব উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় সেগুলোয় কোনো ফল দেয় না। একদিকে উচ্ছেদ অভিযান চললেও একই সময়ে খালের আরেক অংশ দখল করে স্থাপনা গজিয়ে উঠতে থাকে। উচ্ছেদ অভিযানের পাশাপাশি উদ্ধারকৃত জায়গা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নার্সারি গড়ে তোলা বা ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হলে তাতে ফের জবরদখলের সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে একটি প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর খাল-নদীর বেদখলকৃত জায়গা স্থায়ীভাবেই উদ্ধার সম্ভব বলে সচেতন নাগরিকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা গুলশান  লেকের উদাহরণ দিয়ে বলেন, জবরদখলকারীদের কব্জা থেকে এই লেকের জায়গা উদ্ধার করেই সেখানে চমৎকার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সেখানে এক ইঞ্চি জায়গাও আর জবরদখল হয়নি। কারণ ওয়াকওয়ে ডিঙিয়ে কোনো জবরদখলকারী আর লেকের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের সাহসই করছে না। রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা পৃথকভাবে ২০ দফা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও কল্যাণপুর খালটি রক্ষা করতে পারেনি। ওই খালটিতে ২০০৭ সালেই ১১ দফা অভিযান চালিয়ে পুরোপুরি বেদখলমুক্ত করা হয়। কিন্তু দখলমুক্ত জায়গা পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হয়নি। নির্মাণ হয়নি ওয়াকওয়ে, এমনকি নার্সারি পর্যন্ত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বদলোকেরা আরও জোরদার হয়ে আবার দখল করে নিয়েছে খালের বেশির ভাগ জায়গা। এখন খালটির অস্তিত্ব্ব নিশ্চিহ্ন করে মাটি ভরাট হচ্ছে, উদ্যোগ চলছে বহুতল অট্টালিকা নির্মাণের। শুধু কল্যাণপুর খাল নয়, রাজধানীর বিলুপ্ত প্রায় ৩৬টি খাল উদ্ধারের ব্যাপারে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে অন্তত ২১১ বার। রাজউক ও সিটি করপোরেশনে নিযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের তত্ত্বাবধানেও পৃথকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয়েছে। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে একের পর এক বস্তিঘর, বিল্ডিং স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে উদ্ধার করা জায়গা-জমি দুই সপ্তাহের বেশি সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। কারণ উচ্ছেদের পর খালের দুই পাড়ে হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে) নির্মাণ না করায় বা নার্সারি গড়ে না তোলায় আবার দখল হয়ে গেছে খালগুলো। ২০১০ সালে হাই কোর্টের নির্দেশে ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউক, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদফতর এ খালগুলোর দখল হয়ে যাওয়া অংশে উচ্ছেদ অভিযান চালানো শুরু করে। কিন্তু সেই অভিযান খুব একটা স্থায়িত্ব পায়নি। ঢাকার প্রায় প্রতিটি খালের মধ্যে পরস্পরের যোগসূত্র ছিল, এগুলোর সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া প্রধান চারটি নদীর সঙ্গে। স্রোতের পানি সূত্রাপুর লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বসিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে গড়িয়ে পড়ত। সেসব এখন বিস্মৃত অতীত। দিনের পর দিন বৃষ্টি হলেও রাজধানীর কোথাও তখন জলজট হয়নি। আবদুল্লাহপুর খালটি হরিরামপুর, রানাভোলা, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, দলিপাড়া হয়ে বাউনিয়ায় তুরাগ নদীতে গিয়ে মিশেছে। রাস্তা ও রাজউকের প্লটের কারণে খালটি এরই মধ্যে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর অংশে লেকের উত্তর প্রান্ত দখল করা হয়েছে ময়লা ফেলে। আবর্জনা দিয়ে ভরাট করে সেখানে প্লটও তৈরি করা হয়েছে। ১০ নম্বর সেক্টরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বহমান খালটি এখন পুরোপুরি নর্দমা হিসেবেই ব্যবহূত হচ্ছে। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের মাণ্ডা খাল সবুজবাগ থেকে শুরু হয়ে মাদারটেক, দক্ষিণগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বালু নদীতে মিশেছে। দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ৯ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত। দীর্ঘদিন ধরে এটি ওই এলাকার পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তবে দখল-দূষণে অনেক আগেই সঙ্কুচিত হওয়া খালটি এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। খাল কীভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন হলো? প্রশ্নটির কোনো কূলকিনারা বের করতে পারেনি ওয়াসা। ভূমি সংক্রান্ত কাগজপত্রে হাজারীবাগের খালটিও ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। রায়েরবাজার থেকে হাজারীবাগ হয়ে এ খালটি কামরাঙ্গীরচর গিয়ে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে মিশেছে। এটি ওই এলাকার পয়ঃনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম। সিএস, এসএ, আরএস অনুযায়ী এ জায়গা খাস ছিল, শুধু মহানগর জরিপেই এটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হিসেবে দেখানো হয়েছে। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের মূল পথ সুতি খালের অস্তিত্ব এখন চরম সংকটে। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শত শত কাঁচা পাকা ও আধা পাকা স্থাপনা। প্রতিদিনই খালের কোনো না কোনো অংশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, গড়ে উঠছে স্থাপনা। এসব দেখার কেউ নেই। ভূমি দখলদার চক্র জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সুতি খাল ও সরকারি জলাশয় দখল অব্যাহত রেখেছে। সুতি খালের সঙ্গে সংযুক্ত কুতুবখালী খালের অস্তিত্বও সংকটের মুখে। খালটির বেশির ভাগ অংশই দখল হয়ে গেছে। বিপাকে পড়েছে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ স্যুয়ারেজ লাইন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে। খালটি ফের ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। খালের উভয় পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক দোকানপাট, কাঁচা বাজার, মাছ বাজার, মুরগির মার্কেটসহ নানা স্থাপনা। বিলীন হওয়া খালগুলো হচ্ছে— ক্যান্টনমেন্টের উত্তরাংশে বাউনিয়া, মিরপুরের পল্লবী এলাকা ঘেঁষে যাওয়া বাউনিয়া খাল, পল্লবীর রূপনগর, ইস্টার্ন হাউজিং, বোটানিক্যাল গার্ডেনের উত্তর প্রান্ত দিয়ে যাওয়া দিগুণ খাল, খিলগাঁও, বাসাবো ও সবুজবাগ এলাকা দিয়ে প্রবাহিত খিলগাঁও খাল, মুগদাপাড়া, জিরানী ও সবুজবাগ দিয়ে যাওয়া জিরানী খাল, শাহজাদপুর, খিলবাড়িরটেক, নুরেরচালা, বাড্ডা দিয়ে প্রবাহিত শাহজাদপুর খাল, মিরপুরের কসাইবাড়ি ও বোয়ালিয়া এলাকা দিয়ে প্রবাহিত বোয়ালিয়া খালের ৮০ শতাংশেরই আর কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে : বাসাবো খাল ছিল ৬০ ফুট প্রশস্ত এখন প্রশস্ত ১০/১২ ফুট। বেগুনবাড়ী খালে শতাধিক ফুটের জায়গায় আছে ৩৫/৪০ ফুট, মহাখালী খালের প্রশস্ততা ৬০ ফুট, এখন ৩০ ফুট, রামচন্দ্রপুর খালে ১১০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৬০ ফুট, দ্বিগুণ খালে ২০০ ফুটের পরিবর্তে আছে ১৫০ ফুট, ১০০ ফুটের আবদুল্লাহপুর খালে আছে ৬৫ ফুট, কল্যাণপুর খালে ১২০ ফুটের পরিবর্তে আছে ৪০ ফুট। এ ছাড়া গুলশান, বনানী, কাঁটাসুর, ইব্রাহিমপুর, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ী, কল্যাণপুর খাল-ক, খ, ঘ, ঙ ও চ, শাহজাদপুর খালের অবস্থা নাজুক। এগুলোর আংশিক অস্তিত্বও এখন দখলদারদের কারণে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। ধোলাইখাল ভরাট করে প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেছে সিটি করপোরেশন। এমন অসংখ্য নজির রয়েছে রাজধানী এলাকায়। অপরদিকে সরকার নিয়ন্ত্রিত পুকুর-জলাশয় সংস্কার কিংবা পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টরা দেখায় সীমাহীন ব্যর্থতা। গত ১০ বছরেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া পড়েনি ওসমানী উদ্যানের পুকুরে। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত লেক আকৃতির পুকুরটি এখন অযত্নে-অবহেলায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত। বিশ্রী জঞ্জাল ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে ঢাকার দুই হাজার একশ একর জলাভূমি। কোথাও আয়েশে শ্বাস ফেলারও উপায় নেই। রাজধানীর বিল, ঝিল, পুকুর, ডোবা ব্যবস্থাপনার জন্য রাজউক ও সিটি করপোরেশনের জন্য কোনো নীতিমালা নেই। এ দুটি সংস্থার কেউ এসবের দায়দায়িত্ব নিতে চায় না।

সর্বশেষ খবর