শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

খাদ্য সংকট দুর্ভোগে কষ্টে আছে রোহিঙ্গারা

মিয়ানমারে ভয়াবহ নৃশংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি জাতিসংঘ বিশেষ উপদেষ্টার

ফারুক তাহের, উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে

খাদ্য সংকট দুর্ভোগে কষ্টে আছে রোহিঙ্গারা

উখিয়ার থাইংখালী ক্যাম্পে গতকাল এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় শিশুটিকে। খাদ্য সংকটে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু —এএফপি

উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। গত দুদিন ধরে মিলছে না তেমন ত্রাণ সহায়তা। বিশেষ করে আঞ্জুমানপাড়া ও একই সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। জানা গেছে, এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন ছাড়া কোনো বেসরকারি সংস্থা ত্রাণ সহায়তা দিতে পারছে না। বিশেষ করে নতুনদের ক্যাম্পে দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। ফলে নতুন এই রোহিঙ্গারা বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে কোনো রকম খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে না বলে  অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। পাশাপাশি কক্সবাজার এলাকায় টানা বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে বেড়েছে আরও ভোগান্তি। এ অবস্থায় বিভিন্ন এনজিও সংস্থার কর্মকর্তারা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, এতদিন ধরে যেসব বেসরকারি সংস্থা রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছিল, একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য নেওয়া পূর্ব অনুমোদন শেষ হয়ে যাওয়ায় সে সংস্থাগুলো এখন ত্রাণ দিতে পারছে না। ৩০টির অধিক এনজিও রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ দিতে অনুমোদন লাভের জন্য এনজিও ব্যুরোর কাছে আবেদন জানালেও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। উখিয়া ও টেকনাফের নতুন-পুরাতন রোহিঙ্গাদের মাঝে এখন ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, ইউএনএইচসিআরসহ গুটিকয় সংস্থা। সংশ্লিষ্টরা জানান, টাকা ছাড় ও অনুমোদন লাভের ক্ষেত্রে সাধারণত ২৪ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে এক থেকে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এখনো সেসব আবেদনের অনুমোদন মেলেনি। ফলে খাদ্যসহ ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব এনজিও এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসা এনজিও প্লাস বাংলাদেশ, হেলপ ফর নিডি, গ্লোবাল, পাল্স, হোমসহ বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাদের হাতে যে পরিমাণ খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী রয়েছে, তা দু-একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন না মিললে সংকট আরও চরম আকার ধারণ করবে। পাল্স বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এনজিও ব্যুরো থেকে টাকা ছাড় ও অনুমোদন লাভের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা শুরু হয়েছে, যা সাধারণত হওয়ার কথা নয়। যে কাজ মাত্র ২৪ ঘণ্টায় হওয়ার কথা, সে কাজে ২ সপ্তাহেরও বেশি সময় লাগছে। এতে করে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংকট দেখা দেবেই। এদিকে গতকাল উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালংয়ের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, খাদ্য সংকটের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। কোনো গাড়ি টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক ধরে যেতে দেখলেই ত্রাণের গাড়ি মনে করে ছুটে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ পরিস্থিতি শুরুর দিকে দেখা গেলেও মাঝখানে স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। কিন্তু গত দুদিন আবারও রোহিঙ্গাদের খাদ্য সংকট, দুর্ভোগ ও কষ্টকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সংখ্যার তুলনায় বেসরকারি সংগঠন ও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ সহায়তা কমে আসায় এই সংকট দিন দিন চরমে পৌঁছে যাচ্ছে বলে জানান ক্যাম্পে দায়িত্বরত বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। এনজিও ব্যুরোর এক কর্মকর্তা জানান, টাকা ছাড়ের জন্য অনেকগুলো সংস্থা আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু কেন তাদের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না— তা জানি না। বিশেষ করে ফুডগ্রেন নিয়ে যে সব এনজিও কাজ করে, তাদের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে। এটার জন্য রোহিঙ্গারা কষ্ট পাচ্ছে এবং তা অমানবিক। বালুখালী অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় আঞ্জুমানপাড়ার শূন্যরেখা থেকে গত বৃহস্পতিবার আসা বুছিদংয়ের মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে আমিসহ ৬ জন আছি। গতকাল আঞ্জুমানপাড়া থেকে আসার সময় কিছু রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খেয়েই সারা দিন সারারাত পার করেছি। এরপর আর কিছু সহায়তা পাইনি। আমাদের কথা না ভাবলেও ছোট ছোট সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। এভাবে থাকলে আমি সন্তানদের বাঁচাতে পারব না।’ এদিকে বৃহস্পতিবার রাত থেকে কক্সবাজার এলাকায় প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দুর্ভোগ বেড়েছে। ত্রাণের জন্য হাহাকার সৃষ্টি হলেও বৃষ্টিপাতের কারণে ব্যক্তিগত সহায়তাও তেমন আসেনি।

ত্রাণ বিতরণ : ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নারিন্দা মশুরীখোলা দরবার শরিফের পক্ষ থেকে গতকাল কক্সবাজারের উখিয়ার ঘুমধুম ১ নম্বর কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের মাঝে ত্রাণ এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়। দরবার শরিফের পীর আল্লামা শাহ্ মুহাম্মদ আহছানুজ্জামানের নেতৃত্বে ত্রাণ ও অর্থ বিতরণ করেন। তিনি ৭৫০ পরিবারকে কাপড়, শুকনো খাবার, নগদ অর্থ ও  অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। এ সময় শাহজাদা শাহ্ মুহাম্মদ মোহছেনুজ্জামান, শাহজাদা শাহ মুহাম্মদ সাইফুজ্জামান, আল্লামা গোলামুর রহমান আশরাফ শাহ, মুহাম্মদ ইমরান হোসেন তুষারসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

 

ভয়াবহ নৃশংসতা বন্ধের আহ্বান : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এত দিন জাতিসংঘ ‘আক্ষরিক অর্থেই জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে উল্লেখ করলেও এবার সেখানে ‘গণহত্যা’, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ ও ‘যুদ্ধাপরাধ’ সংঘটিত হওয়ার ইঙ্গিত করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রথমবারের মতো গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ উপদেষ্টা আদামা ডিয়েং ও সুরক্ষার দায়িত্ববিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা ইভান সিমোনোভিত্চ যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। তারা মিয়ানমারকে ‘ভয়াবহ নৃশংস অপরাধ’ থামানোর আহ্বান জানিয়ে বিবৃতির একেবারে শেষে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে লিখেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ— এ তিন ধরনের অপরাধ বোঝাতেই তারা ‘ভয়াবহ নৃশংস’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন।

সর্বশেষ খবর