শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৫০

কাক খুলে দেয় খুন রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

কাক খুলে দেয় খুন রহস্য

রাজধানীর হাতিরপুলের নাহার প্লাজা। এক সকালে আট-দশ ব্যক্তি মার্কেটে একটি অফিসের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। ভিতর থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় তারা দরজায় আঘাত করে। মিনিট পাঁচেক পর ভিতর থেকে দরজা খুলে দেন বাচ্চুু। বাইরে বিক্ষুব্ধ লোকজন। তারা বাচ্চুকে গালাগাল করতে থাকে। কী ব্যাপার, আপনারা চিৎকার করছেন কেন? প্রশ্ন রাখেন বাচ্চুু। লোকজন আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাচ্চুকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢোকে তারা। বলতে থাকে, কই, মেয়েটা কোথায়? বাচ্চু আকাশ থেকে পড়েন। বলেন কী? কীসের মেয়ে? কার কথা বলছেন? লোকজন তার কলার ধরে বলে, ন্যাকামি ছাড়। কাল রাতে যে মেয়েকে নিয়ে এসেছিস সে কোথায়? বাচ্চু বলেন, না ভাই, আপনারা ভুল বুঝতেছেন। এখানে কোনো মেয়েমানুষ নেই। পুরো অফিস তল্লাশি করে কাউকে পায় না। তারা বাচ্চুর কাছে সরি বলে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। বাচ্চুর ঘাড় থেকে যেন পাহাড় নেমে গেল।

বাচ্চু বিছানায় বসে ভাবছেন। কোথা থেকে কী হয়ে গেল। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। আবারও অফিসের দরজায় আঘাতের শব্দ। ঘুম ভাঙে বাচ্চুর। ঘড়িতে তখন বেলা ১১টা। তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছিলেন, ভাবতেই পারছেন না কিছু। আবারও দরজায় আঘাতের শব্দে মেজাজ গরম হয়ে যায় বাচ্চুর। ভাবছেন, ওই সম্পর্কে আবারও কিছু বলতে গেলে খুব খেপে যাবেন তিনি। মারতেও পারেন। দরজা খুলে দেন বাচ্চু। তার বুক কেঁপে ওঠে। দরজার সামনে পুলিশ দাঁড়ানো। বাচ্চু থতমত খান। তোতলাতে থাকেন। পুলিশকে বলেন, ভাই আপনারা? কী ব্যাপার? গটগট করে পুলিশ ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঠাস করে বাচ্চুর গালে চড় দেয় পুলিশ। নাটক করছিস? বল মেয়েটি কোথায়? আবারও বাচ্চুর ছলচাতুরীর আশ্রয়। পুলিশ বলে, বল এবার মেয়েটি কই? বাচ্চুর অস্বীকার। এবার পুলিশ বলে, মেয়েটিকে টুকরা টুকরা করতে গেলি! এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে চেহারা পরিবর্তন হয় বাচ্চুর। যা পুলিশের চোখ এড়ায় না। পুলিশ নিশ্চিত হতে পারে, জঘন্যতম কাজটি বাচ্চুর। পুলিশ বাচ্চুকে বলে, একটি কাক তোর সর্বনাশ করেছে। একটি হাতের কব্জি যদি কাক মুখে তুলে রাস্তায় না ফেলত, কেউ কোনো কিছুই বুঝতে পারত না। কিন্তু খুনের রহস্য উন্মোচিত হয় একটি কাকের জন্যে। ২০১২ সালের ১ জুন হাতিরপুলের নাহার প্লাজার ১৩ তলায় ১৩০৮ নম্বর কক্ষে এই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। সোনালি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক সাইদুজ্জামান বাচ্চু ওই কিশোরীকে ডেকে আনেন। ওই কক্ষেই তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করেন। পরে দা দিয়ে ওই কিশোরীর মাথা ও দেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন করে জানালা দিয়ে পাশের গলি, নাহার প্লাজার পাশে নিজামউদ্দিনের বাসার ছাদ ও বাথরুমের কমোডে ফেলে দেন। পরে একটি কাক কব্জি নিয়ে রাস্তায় ফেললে তা সবার নজরে আসে। পুলিশ এসে বাচ্চুকে গ্রেফতার করে। পরে ১৫ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং লাশ ২৬ টুকরা করার ঘটনায় একমাত্র আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। এ বছর ৫ এপ্রিল ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক রায় দেন। কিন্তু রায়ের আগেই বাচ্চু জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর লাপাত্তা বনে যান। আজও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গাজীপুর-কাজীপাডার মৃত সাদ্দাম ফকিরের মেয়ে রুমি। তারা চার বোন। দুই বোন আগে থেকেই মিরপুরে একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। ঘটনার মাসখানেক আগে রুমিও বোনের বাসায় এসে একই গার্মেন্টে চাকরি শুরু করেন। ফরিদপুরের মধুখালীর বকশিচাঁদপুরের বাছের আলীর ছেলে সাইদুজ্জামান বাচ্চু। ঘটনার আড়াই বছর আগে রুমির সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে পরিচয়। এরপর প্রেমের ফাঁদ পাতেন তিনি। এরপর হত্যা। পুলিশের জেরার মুখে বাচ্চু বলেন, ‘আমি ভুল করেছিলাম। যদি হাতের আঙুলের মাংসগুলো ছাড়িয়ে নিতাম তবে কাক সেটি নিয়ে রাস্তায় ফেলত না। আমি ধরা পড়তাম না।’ এ সময় বাচ্চুর মুখে হত্যা ও লাশ টুকরা টুকরা করার নৃশংসতার বর্ণনা শুনে স্তব্ধ হয়ে যান সবাই। বাচ্চু বলেন, রুমি নিজেই তার অফিসে আসার কথা বলেছিল। তার ফোন পেয়ে তিনি তাকে মিরপুর থেকে সিএনজিচালিত আটোরিকশায় করে নিয়ে আসেন। বাচ্চু বলেন, ‘নাহার প্লাজার ১৩০৮ নম্বর কক্ষটি ভাড়া নিয়ে আমি দুই বছর ধরে ব্যবসা করছি। কয়েক বছর আগে রুমির সঙ্গে আমার মোবাইল ফোনের সূত্রে পরিচয়। আমাদের দুজনের বাড়ি একই জেলায় হওয়ায় আমাদের মধ্যে খাতির তৈরি হয়। এক বছর আগে ঢাকার সংসদ ভবন এলাকায় আমাদের সাক্ষাৎ হয়। আমি তাকে নকিয়া ১১০০ মডেলের একটি মোবাইল ফোন সেট কিনে দিই। গত শুক্রবার ঘটনার দিন রুমি ফোন করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। বিকাল ৫টার দিকে আমি মিরপুর ১০ নম্বরে গিয়ে তাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নাহার প্লাজায় নিয়ে আসি। তাকে আমার অফিস ১৩০৮ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাই। আমরা যখন নাহার প্লাজায় ঢুকি তখন লিফট থেকেই কিছু লোক আমাদের ফলো করছিল। আমি রুমিকে আমার অফিসকক্ষে নিয়ে দরজা আটকে দিলাম। তাকে কিস করি। তখনই দরজার বাইরে কিছু লোক নক করে। আমরা দুজন ভয় পেয়ে যাই। আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। চিন্তা করি ধরা পড়লে অফিসটা ছেড়ে দিতে হবে। মান-ইজ্জত কিছুই থাকবে না। নানা চিন্তার একপর্যায়ে রুমিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিই। রুমি শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তাকে গলা টিপে হত্যা করি। তখনো দরজার বাইরে লোকজন কথা বলছিল। এরপর লাশ বাথরুমে নিয়ে যাই। চিন্তা করি লাশ বাইরে বের করা সম্ভব হবে না। সিদ্ধান্ত নিই লাশ কেটে হাড্ডিগুড্ডি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেব। মাংসগুলো বাথরুমে ফ্লাশ করে দেব। অফিসে পিয়াজ কাটার ছুরি ছিল। সেটা দিয়ে রুমির মাথাটা কেটে আলাদা করে রাখি। দুই হাত ও দুই পায়ের জয়েন্ট আলাদা করি। এগুলো কেটে তিন ভাগ করি। বডিটা গলা থেকে নাভি পর্যন্ত টান দিয়ে কেটে দুই ভাগ করে ফেলি। নাড়িভুঁড়ি ছোট ছোট করে সাইজ করি। সেগুলো অল্প অল্প করে কমোডে ফেলে ফ্লাশ করে দিই। ওই ছুরি দিয়ে হাত ও পায়ের মাংসগুলো ছাড়িয়ে নিই; যাতে গন্ধ না ছড়ায়। হাড়গুলো জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিই। রুমির পরনের ওড়না, সালোয়ার ও কামিজ কাঁচি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে কমোডে ফ্লাশ করে দিই। মাথাটা জানালা দিয়ে ঢুকছিল না। মাথার দুই পাশ কেটে ছোট করে বাইরে ফেলে দিই। রুমি ব্রা পরেনি। শেমিজ দিয়ে বাথরুম ও ঘরের মেঝের রক্ত পরিষ্কার করেছি। এসব কাজ করতে ভোর সাড়ে ৪টা বেজে যায়। ভোরে নাহার প্লাজার ম্যানেজার ইলিয়াসকে বলি, আমি দরজা খুলব। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে রাতে আমার দরজায় নক করা লোকগুলো আবার আসে। তারা সবাই নাহার প্লাজার দোকানদার, কর্মচারী। তারা মেয়েটির খোঁজ করে। রুম সার্চ করে। কিন্তু তারা কিছুই বুঝতে পারেনি। সকালে ছাদে ফেলে দেওয়া রুমির একটা কব্জি কাক নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ফেলে। কিন্তু কব্জির আঙ্গুলের মাংসগুলো যদি ছাড়িয়ে নিতাম, তাহলে কাক সেটি নিয়ে রাস্তায় ফেলত না। আমি ধরা পড়তাম না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর