রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্থবিরতা সারা দেশে নৌ চলাচল বন্ধ

প্রতিদিন ডেস্ক

টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে স্থবির হয়ে পড়েছে জীবন। গভীর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে এ বৃষ্টিপাত। ভারি বৃষ্টির কারণে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলসহ ফসলি জমি, মাছের ঘের। এতে জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। অতিপ্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। বৈরী আবহাওয়া, পদ্মায় তীব্র স্রোত ও ঘূর্ণায়মান ঢেউয়ের কারণে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে সব নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল ভোর থেকে এসব বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট ১০ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। বরিশাল-ভোলা ও বরিশাল-ইলিশা মজু চৌধুরীর হাট রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে দুই দিন ধরে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। দেয়ালচাপায় গাজীপুরে নারী, শিশু এবং কুষ্টিয়ার মিরপুরে ঘুমন্ত অবস্থায় এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে বৃষ্টিতে ফের তলিয়ে গেছে বন্দরনগর চট্টগ্রাম। নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর— মানিকগঞ্জ : টানা দুই দিন বৃষ্টির কারণে ফেরি পারাপারে বিঘ্ন ঘটায় পাটুরিয়া ঘাটে আটকা পড়েছে সাত শতাধিক যানবাহন। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রী ও শ্রমিকরা। বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মহিউদ্দীন রাসেল জানান, গত শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা থেকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে এই নৌরুটের ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এই নৌরুটের সব ফেরিই ঘাটে নোঙর করে রাখা হয়। আবহাওয়া অনুকূল হলে গতকাল দুপুর ১২টায় ফেরি চলাচল শুরু হয়। এ সময় ঘাটের পাটুরিয়া প্রান্তে পণ্যবাহী ট্রাকসহ কয়েক শ যানবাহন আটকে পড়ে।

মুন্সীগঞ্জ : লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোটসহ সব নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বৈরী আবহাওয়া, পদ্মায় তীব্র স্রোত এবং ঘূর্ণায়মান ঢেউয়ের কারণে গতকাল ভোর থেকে এসব বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন জানান, শুক্রবার সকাল থেকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফেরি চলাচল ব্যাহত হয় এবং গতকাল সকাল থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় ঘাট এলাকায় পাঁচ শতাধিক যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে যাত্রীরা পড়েছেন চরম বিপাকে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ঢাকায় ফিরে গেছেন। এদিকে গতকাল দুপুরে শিমুলিয়া ২ নম্বর ফেরিঘাটের পন্টুন ডুবে গেছে। তা পুনরুদ্ধারে কাজ চলছে।

গাজীপুর : কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাতের মধ্যে গাজীপুরে পৃথক স্থানে দেয়ালচাপায় এক নারী ও এক শিশু নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে আরও দুজন। গতকাল ভোরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পুবাইল ও সদর উপজেলার কাইঞ্জানুল এলাকায় এ দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হচ্ছে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার চাদালচরের সুমন মিয়ার ছেলে মো. জাহিদ মিয়া (২) ও ঠাকুরগাঁওয়ের রাউতনগরের উত্তরগাঁও এলাকার এরাজুল হকের স্ত্রী সেলিনা আক্তার (৩০)।

বরিশাল : বৃষ্টিতে নাকাল বরিশালসহ উপকূলীয় এলাকার মানুষ। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চলসহ ফসলি জমি, মাছের ঘের। নগরের নবগ্রাম রোড, কালীবাড়ী রোড, বগুড়া রোড, মল্লিক রোডসহ বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতাসহ আশপাশের বাসাবাড়ি ও দোকানেও ঢুকে গেছে পানি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে নগরবাসী। বরিশাল-ভোলা ও বরিশাল-ইলিশা মজু চৌধুরীর হাট রুটের লঞ্চ চলাচলে জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। বরিশাল আবহাওয়া অফিস জানায়, গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় ১৯৩.১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে; যা চলতি বছর এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত।

খুলনা : টানা বৃষ্টিতে খুলনা মহানগরীর শান্তিধাম মোড়, ফারাজিপাড়া, শামসুর রহমান রোড, রয়্যালের মোড়, কেডিএ এভিনিউ, পিটিআই, নিরালা, বাগমারা, ডাকবাংলা, রূপসা স্ট্যান্ড রোডসহ বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কে হাঁটুপানি জমে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতার। অনেকের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি। নদ-নদীতে বৃদ্ধি পেয়েছে পানি। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ। পানিবন্দী নিম্নাঞ্চলের হাজারো পরিবার। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে নগরীর অধিকাংশ স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল কম। ভাসমান মানুষের কষ্টের সীমা নেই। দিনভর বিরামহীন বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। এদিকে ভারি বর্ষণের কারণে মোংলা বন্দরে অবস্থান করা জাহাজে পণ্য ওঠানো-নামানো সাময়িক বন্ধ থাকলেও বৈরী আবহাওয়া কেটে যাওয়ার পর তা স্বাভাবিক হয়েছে।

নোয়াখালী : ঘূর্ণিঝড়ে নোয়াখালী সদর ও হাতিয়ায় অর্ধশত বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে। হাতিয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়। নিঝুমদ্বীপে শতাধিক বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকাল সকালে জেলা সদরের অশ্বদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ অশ্বদিয়া ও নাজির গ্রামে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এতে দুটি গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এ সময় তালুক বরকত উল্লা মাদ্রাসা-মসজিদসহ অর্ধশত কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এদিকে প্রচণ্ড সামুদ্রিক জোয়ারে হাতিয়ার সুকচর বেড়িবাঁধ ভেঙে কাজির সরদার ও চর আমান উল্লা গ্রাম পানিতে ডুবে যায়। এ ছাড়া টানা ভারি বর্ষণের ফলে উপজেলার শত শত একর আগাম শীতকালীন সবজি, রাজাশাইল উঠতি ধান নষ্ট হয়ে গেছে। নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মেরাজ জানান, ইউনিয়নের ৯ নম্বর মোল্লা গ্রামের শতাধিক কাঁচা ঘর নদীতে তলিয়ে গেছে। এ সময় ঘর পড়ে দুজন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এদিকে হাতিয়ার সঙ্গে জেলা সদরের নদীপথের একমাত্র যাতায়াত সি-ট্রাক বন্ধ রয়েছে।

কুষ্টিয়া : মিরপুরে বসতবাড়ির মাটির দেয়াল চাপা পড়ে ঘুমন্ত অবস্থায় এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তার নাম রূপচাঁদ মল্লিক (৫২)। গতকাল ভোরে উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের মল্লিকপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন পিস্তল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চট্টগ্রাম : গতকাল বিকাল ৪টার পর শুরু হয় কয়েক ঘণ্টার ভারি বর্ষণ। এতে নগরের আগ্রাবাদ, চান্দগাঁও, চকবাজার, বাদুড়তলা, আরাকান হাউজিং, মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, হালিশহর, বাকলিয়া, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়িতে। অভিযোগ রয়েছে, নগরের খাল-নর্দমাগুলো প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করা হয় না। লোক দেখানো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কারণে জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসী মুক্তি পাচ্ছেন না। নগরের অনেক খালই আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। এসব খাল ভালো করে খনন করার তেমন উদ্যোগ নেই। বরং কিছু কিছু খাল থেকে আবর্জনা তুলে খালের পাড়ে রাখা হয়। ফলে বৃষ্টি হলে সেই আবর্জনাগুলো ফের খালে গিয়ে পড়ে।

রাজশাহী : টানা বর্ষণে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে রাজশাহীর জনজীবন। স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের উচ্চ পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজশাহীতে ৯১ দশমিক ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত হয়েছে আরও ৩০ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি।

নেত্রকোনা : জেলা সদরসহ হাওর উপজেলাগুলোয় শুক্রবার থেকে প্রবল ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাজে যেতে পারছেন না নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। হাওরগুলোয় প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে সকল প্রকার নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে হাওরের যাত্রীরা বিপদে পড়েছেন।

ভোলা : দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মেঘনা নদী উত্তাল হয়ে ওঠায় ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে দুই দিন ধরে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। আটকা পড়েছে কয়েক শ পণ্যবাহী যানবাহন।

পটুয়াখালী : বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে ১৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে অর্ধশত চরসহ জেলার বেশির ভাগ পুকুর ও মাছের ঘের। পায়রা সমুদ্রবন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। অভ্যন্তরীণ সব রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

বরগুনা : জোয়ারের পানি আর অতিবৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চলের ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল ভোররাতে আকস্মিক টর্নেডোয় পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের কালীবাড়ী ও কিরণপুর গ্রামে ৪০টি বসতঘর ও ১০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। ঘরের চালে ও গাছের নিচে চাপা পড়ে রেণু (৪৮) নামে এক গৃহবধূ আহত হয়েছেন।

বগুড়া : টানা বৃষ্টির কারণে প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হয়নি। গতকাল সকাল থেকেই শহর ছিল অনেকটা জনশূন্য। বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ পরীক্ষার্থীরা।

সর্বশেষ খবর