সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মন্ত্রণালয়ে গুরুত্ব নেই দুদকের

সরকারি ক্রয়, নিয়োগ ও প্রকল্পে দুর্নীতি প্রতিরোধে মনিটরিং ব্যবস্থা করতে বারবার চিঠি দিলেও ব্যবস্থা নেয় না কেউই

গোলাম রাব্বানী ও মোস্তফা কাজল

রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশ আমলে নিচ্ছে না মন্ত্রণালয়গুলো। পাত্তা দিচ্ছে না দুদক চেয়ারম্যানের চিঠিকেও। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া, জনবল নিয়োগ ও প্রকল্পের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রো-অ্যাকটিভ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে এক বছর আগে দুদক চেয়ারম্যানের পক্ষ মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অনুরোধ করা হলেও এ বিষয়ে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন আইন, ২০০৪-এর আলোকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরে দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকে বেশ কিছু সুপারিশ থাকলেও তা কোনো মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করছে না। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে দুদকের প্রো-অ্যাকটিভ মনিটরিংয়ের প্রস্তাবেও কেউ সাড়া দিচ্ছে না। অর্থাৎ দুদকের প্রস্তাব তারা আমলে নিচ্ছে না। দুদক মনে করছে, দেশের দুর্নীতির উৎস হচ্ছে চলমান টেন্ডার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনাসহ সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ ই-টেন্ডার চালুর সুপারিশ রয়েছে দুদকের। এ ছাড়া দুদক চেয়ারম্যানের চিঠিতে দুর্নীতির ধূসর এলাকাসমূহের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, সংস্থাগুলোকে দুদকের পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

জানা গেছে, গত বছর ৩১ অক্টোবর দুর্নীতি প্রতিরোধে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে একটি অনুরোধপত্র দেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এরপর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ২৮ ডিসেম্বর সেই চিঠির অনুলিপিসহ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সব সচিবকে নির্দেশনা দিলেও কেউ তা আমলে নিচ্ছেন না এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদককে সহযোগিতাও করছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও পরিদফতরের মেগা প্রকল্পের টেন্ডার, প্রকল্পের আর্থিক বরাদ্দ, জনবল নিয়োগসহ সরকারি কাজের সব ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা নিশ্চিতের স্বার্থে দুদকের প্রতিনিধি রাখার জন্য এক বছর আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনিও সব সচিবকে আমার পত্রের বিষয়ে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু দুদক কোনো ধরনের সহযোগিতা আজ অবধি পায়নি।’

জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের চিঠি পাওয়ার পর অনেক সচিব তার সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কেউ সেই চিঠিকে পাত্তা দেয়নি। সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর ১৫ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে সিনিয়র সহকারী সচিব জাহিদ হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি স্থানীয় সরকার বিভাগের সব দফতরে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হতে প্রাপ্ত আধা-সরকারি পত্রটি সঙ্গে প্রেরণ করা হলো। উক্ত আধা-সরকারি পত্রের নির্দেশনা মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ কিন্তু এই চিঠি ফাইলবন্দী থাকছে সংশ্লিষ্ট দফতরে। কেউ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে দুদকের কাছে কোনো তথ্য নেই। এ অবস্থা শুধু এই স্থানীয় সরকার বিভাগেই নয়। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দুদকের এই চিঠি এক বছর ধরে ফাইলবন্দী রয়েছে। কেউ কোনো অগ্রগতি জানাচ্ছে না। এ ছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই চিঠির অনুলিপি দেখা গেছে। অনেক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই চিঠির অগ্রগতি জানতে চেয়ে নির্দেশনাও ঝুলতে দেখা গেছে। এমনকি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে অগ্রগতি জানাতে বলা হলেও সংশ্লিষ্ট দফতর কোনো সাড়া দেয়নি। এরপর আবারও সাত দিন, তিন দিন সময় দিয়েও কোনো অগ্রগতির প্রতিবেদন পাচ্ছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার ১০টি মেগা প্রকল্প ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ ভিত্তিতে কাজ শুরু করে। এগুলোর জন্য ২০১৬ সালে পৃথক বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এর মধ্যে আছে— মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র, রামপাল পাওয়ার প্লান্ট, পায়রা সমুদ্রবন্দর, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেল লিঙ্ক প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি প্রকল্প। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬ সালের ২ জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে জাতীয় বাজেট ঘোষণার সময় ১০টি ফাস্ট ট্র্যাক মেগা প্রকল্পের মধ্যে আটটির জন্য ১৮ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। এ ছাড়া জাইকা সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ, কাঁচপুর, মেঘনা, গোমতী সেতু পুনর্বাসন ও নির্মাণ, ভেড়ামারা কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট, পশ্চিমাঞ্চলে ৬১টি সেতু নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ ও বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর রেলসেতু নির্মাণের সমীক্ষা। মেগা প্রকল্পগুলো ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা।

দুদকের সুপারিশ : সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে দুদক কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে— সব নিয়োগে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য মৌখিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ১০ নম্বর বরাদ্দ করার প্রথা চালু; সরকারি পদে নিয়োগের জন্য চার ধরনের পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ। এ ছাড়া সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতার জন্য শতভাগ ই-টেন্ডারিং চালু; টেন্ডার প্রক্রিয়া ও ক্রয়ে যথাযথ স্বচ্ছতার জন্য মন্ত্রণালয়ভিত্তিক শক্তিশালী মনিটরিং টিম গঠন এবং বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকালে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক প্রো-অ্যাকটিভ মনিটরিংয়ের প্রস্তাব গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর