সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৫২

তিন দিনের রক্তাক্ত অভিযান

মির্জা মেহেদী তমাল

তিন দিনের রক্তাক্ত অভিযান

মধ্যরাত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একটি বাড়ির সীমানা প্রাচীরের বাইরে সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে আছে। দোতলা সেই বাড়িটির আলো নেভানো। একটু আগেও বাড়ির বেশ কয়েকটি রুমের আলো জ্বলছিল। এখন বাড়ির সামনের লনেও আলো নেই। অন্ধকারের মধ্যে ভিতরটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবুও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের নল ওই বাসার ভিতরের দিকে তাক করা। তারা এসেছে বড় মাপের এক অপরাধীকে পাকড়াও করতে। যিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘুম হারাম করে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরেই। যে কারণে অভিযানের অংশ নেওয়া সদস্যরা আছেন ভিষণ টেনশনে। ফিসফাস করে কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে। বাসার সামনের সড়কে পার্ক করা অসংখ্য গাড়ি। সবই অভিযানে আসা সদস্যদের। হঠাৎ ভবনটির ভিতরের দরজা খোলার শব্দ। প্রাচীরের বাইরে অবস্থান নেওয়া সশস্ত্র সদস্যরা অ্যালার্ট। একদম চুপ। তারা চোখ বড় করে ভিতরের অবস্থা দেখার চেষ্টা করছেন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একজনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে! কিন্তু লোকটি কে? কী করবে সশস্ত্র রক্ষীরা? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর বের করার চেষ্টা পদস্থ কর্মকর্তাদের। গুলি করলে অপরাধী অ্যালার্ট হয়ে যেতে পারে। অথবা সাধারণ মানুষেরও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন ভাবনার মধ্যেই ঘটল দুর্ধর্ষ ঘটনা। বেরিয়ে আসা যুবকটির দুই হাত প্যান্টের দুই পকেটে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই যুবকটি দুই পকেট  থেকে কাউবয় স্টাইলে দুটি পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তল বের করলেন। সামনের দিকে একটু ঝুঁকলেন। সামনে এগিয়ে রাখা পা একটু ভেঙেই দুই হাতের দুই পিস্তল সচল করলেন। ঠাস ঠাস শব্দ আর আলোর ঝলকানি। যুবকটির পেছনে এসে দাঁড়াল আরও দুজন। গুলি চালাতে চালাতে এবার তিনজচনই একটু সাইড হচ্ছেন। প্রাচীরের ওপাড়ে থাকা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ভয়ঙ্করভাবে তেতে উঠছে। ভবনের ভিতরে আর্ত-চিৎকারের শব্দ। প্রাচীরের বাইরেও দুই সদস্য রক্তাক্ত অবস্থায় গড়াগড়ি খাচ্ছেন। ভবনের ভিতরে অস্ত্রধারীদের মধ্যে একজনের শরীরে বেশ কয়েকটি গুলিবিদ্ধ হয়। ওই অবস্থাতেই যুবকটি কমান্ডো স্টাইলে লাফিয়ে পাঁচিল টপকে বাড়ির বাইরে! সঙ্গে তার দুই সহযোগীও। দ্রুত তারা চড়ে বসলেন ভবনের পেছনের একটি গোপন স্থানে পার্ক করে রাখা মাইক্রোবাসে। র‌্যাব সদস্যরা এ সময় গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। ততক্ষণে মাইক্রোবাসটি হাওয়া। রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বও সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ এভিনিউয়ে র‌্যাবের অভিযান এটি। হাতের নাগালে পেয়েও  গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে। কমান্ডো স্টাইলে র‌্যাবের সামনে দিয়েই গুলি করতে করতে পালিয়ে যান তিনি। কিন্তু রক্তাক্ত এ অভিযানটি শেষ হয় তিন দিন পর। ক্রসফায়ারে তিনজন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। নিশ্চিহ্ন করে দেশের অন্যতম এক মাদকসম্রাট পিচ্চি হান্নানকে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের তিনি ছিলেন একজন গডফাদার। গ্রেফতার ও মৃত্যু : উত্তরা ২ নম্বর গরিবে নেওয়াজ এভিনিউর ২ নম্বর বাড়িটি একজন প্রবাসীর। পিচ্চি হান্নানের ব্যবসায়ী বন্ধু বাবুল টাওয়ারের মালিক বাবুলের মাধ্যমে উত্তরার ওই বাসায়  যেতেন পিচ্চি হান্নান। ওখানে পিচ্চি হান্নান এবং তার বন্ধু-বান্ধব মিলে ফুর্তি করতেন। পিচ্চি হান্নান নিয়মিত সেখানে  যেতেন। র‌্যাব এ সংবাদ পাওয়ার পর ২০০৪ সালের ২৪ জুন দিবাগত মধ্যরাতে অভিযান চালায় ওই বাসায়। কিন্তু পিচ্চি হান্নান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালাতে সমর্থ হন। ওই বাসা থেকে  গ্রেফতার হন পিচ্চি হান্নানের সহযোগী জাকির, বাবুল,  দেবাশীষ, সাহেব আলী ও নিটেলসহ আরও কয়েকজন। ওদিকে গুলিবিদ্ধ পিচ্চি হান্নান তার দুই সহযোগীকে নিয়ে প্রথমে আশুলিয়া যান। সেখানে যুবদলের এক নেতার বাসায় গিয়ে রক্তমাখা কাপড় পরিবর্তন করেন। সেখান থেকে তারা সাভারের আরেক যুবদল নেতার বাসায় যান। ওই নেতাই সাভারের ইনসাফ ক্লিনিকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। ক্লিনিকে পিচ্চি হান্নানের শরীর থেকে কয়েকটি গুলি বের করা হয়। দুই দিন পর র‌্যাব জানতে পারে এ খবর। র‌্যাবের একটি দল  সেখানে গিয়ে হাজির। দোতলার একটি কক্ষে ছিলেন পিচ্চি হান্নান। র‌্যাবের এক সদস্য তাকে প্রশ্ন করেন, ‘কিরে, উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন এখানে এসেছিস’। পিচ্চি হান্নান তখন খুব বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘না স্যার, আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি’। র‌্যাব অফিসার তখন তার গুলিবিদ্ধ স্থানে একটু চাপ দিয়ে বলে, ‘তাই নাকি। এখন বল, হান্নান, তোর গুলিটা কোথায় লেগেছে? এখানে? না এখানে?’ ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে হান্নান। বলে, ‘ও স্যার, স্যার আমি হান্নান। ভাই আমি এই মুহূর্তে এক কোটি টাকা দেব, আমাকে ছেড়ে দিন। মোবাইল  ফোনটা দেন, টাকা আনতে বলি।’ এতে র‌্যাব কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাকে সেখান থেকে আদালতে নেওয়া হয়। সেই দিনই র‌্যাব কার্যালয়ে আনার পর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে বের হয় র‌্যাব। আশুলিয়ায় ক্রসফায়ারে নিহত হন হান্নান। হান্নানের সহযোগী নিটেল ও সাহেব আলীও ক্রসফায়ারে নিহত হন। আবদুল হান্নান ওরফে পিচ্চি হান্নান। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক ডন। যিনি রাজধানীর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন। শীর্ষস্থানীয় এই মাদক ব্যবসায়ীর মূল আস্তানা ছিল ঢাকার কারওয়ান বাজার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ২৩টিরও বেশি মামলা ছিল। এর মধ্যে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান মণ্ডল হত্যা মামলা, ওয়ার্ড কমিশনার শাহাদাত হোসেন হত্যা মামলা, এসআই হুমায়ুন কবির হত্যা মামলা রয়েছে। এ ছাড়া ফার্মগেট, পান্থপথে পথ চলতে গিয়েও গুলি করে হত্যা করার ঘটনা রয়েছে তার অপরাধ জীবনে। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের চরদুখিয়া ইউনিয়নের ওয়াজিউল্লাহর পাঁচ সন্তান। এর মধ্যে হান্নান দ্বিতীয়। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি। রাজধানীতে তার বাবার কাঁচামালের ব্যবসা ছিল। প্রথম পর্যায়ে তিনি কারওয়ান বাজারে সেই কাঁচামালের ব্যবসাই দেখাশোনা করতেন। কালক্রমে ছিনতাই চুরির মতো অপরাধ করে হাত পাকিয়ে খুন, ডাকাতি আর অপহরণের মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। চাঁদপুরের এই হান্নান ১৯৯৬ সালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পান্থপথ এলাকায় মাদক ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময়ে স্টার বেকারির পাশে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা চালান পিচ্চি হান্নান। গুলি করে হত্যা করে রানা নামে এক যুবককে। ওটাই ছিল খুনের হাতেখড়ি। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। গড়ে তোলেন শক্তিশালী বাহিনী। পিচ্চি হান্নানের অস্ত্রের ভাণ্ডারে তখন অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীর আরেক ডন কালা জাহাঙ্গীরকে হত্যা করে নিজের শক্তি সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটান আন্ডারওয়ার্ল্ডে। পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সব সরকার আমলেই সরকারের কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন, যারা সরাসরি সহযোগিতা করতেন পিচ্চি হান্নানকে। এমন পুলিশ কর্মকর্তাও ছিলেন, যিনি কিনা পিচ্চি হান্নানের ফেনসিডিল ভর্তি ট্রাক পাহারা দিয়ে খালাস করাতেন। আর এ জন্য পিচ্চি হান্নান মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতেন। রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ কালা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কালা জাহাঙ্গীর আর পিচ্চি হান্নান মূলত এক সঙ্গেই বিভিন্ন মিশনে অংশ নিতেন। খুনের ঘটনাগুলোতেও তারা থাকতেন একসঙ্গে। ’৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তারা বিএনপির একই প্রার্থীর হয়ে কাজ করেছেন। তারা আন্ডারওয়ার্ল্ডের ত্রাস হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সমর্থ হয়। পিচ্চি হান্নান ও কালা জাহাঙ্গীরের এই গ্রুপের মাসে চাঁদা উঠত কোটি টাকার ওপর। রাজধানীতে তারা গাড়ি-বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। সূত্র জানায়, পিচ্চি হান্নান চলাফেরা করতেন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেহরক্ষী থাকত চারপাশ ঘিরে। তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কোনো এলাকায় তিনি যাওয়ার পরিকল্পনা করলে অগ্রবর্তী দল গিয়ে সিগন্যাল দেওয়ার পর তিনি রওনা দিতেন।

সর্বশেষ খবর