সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ঢাকায় জনসভা

শেখ হাসিনার অধীনে ভোট নয় : খালেদা

নির্বাচনে ইভিএম চলবে না, সেনা মোতায়েন করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

শেখ হাসিনার অধীনে ভোট নয় : খালেদা

খালেদা জিয়া গতকাল জনসভায় বক্তব্য দেন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে নয়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘দলীয় সরকার তো নয়ই, শেখ হাসিনার অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না, হবেই না। নতুন নির্বাচন কমিশনকে বলব, দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করার দায়িত্ব আপনাদের। আপনারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলুন। গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি আয়োজিত এক জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে এ জনসভার আয়োজন করা হয়। জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচনে ইভিএম চলবে না। সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। শুধু মোতায়েনই নয়, তাদেরকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে। তিনি আবারও জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘গণতন্ত্রে মত ও পার্থক্য থাকবে। দেশের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ গতকাল বেলা পৌনে ২টায় কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে জনসভার কার্যক্রম শুরু হয়। বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে বক্তব্য শুরু করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বেলা পৌনে ২টায় জনসভা শুরুর আগেই জনসভাস্থল কানায় কানায় ভরে যায়। জনসভা অনেকটা নির্বাচনী সভায় রূপ নেয়। সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদের নিয়ে শোডাউন করেন। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হলে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না। হাসিনার অধীনে তো নির্বাচন হবেই না। আমরা বিশ্বাস করি মানুষ আমাদের শক্তি, জনগণ আমাদের শক্তি। জয় আমাদের হবেই হবে। জনসভায় নেতা-কর্মীদের আসতে বাধা দেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই কাজ করে সরকার ছোট মনের পরিচয় দিয়েছে। এত ছোট মন দিয়ে রাজনীতি ও জনগণের সেবা করা যায় না। আমি আপনাদের চ্যালেঞ্জ করছি, আপনারা বাধা না দিয়ে দুটি জায়গায় জনসভা দিতেন, একটা আপনাদের, আরেকটা আমাদের। দেখতেন কার জনসভায় মানুষ আসে। কারণ মানুষ আমাদের ভয় নাই, তারা আমাদের ভালোবাসা, তারাই আমাদের শক্তি। দীর্ঘ ১৯ মাস পর বেগম খালেদা জিয়ার এই জনসভায় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক-উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায়। সকাল থেকেই বাদ্য-বাজনা নিয়ে মিছিলে মিছিলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করে নেতা-কর্মীরা। এ সময় তাদের হাতে ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছবি সংবলিত ফেস্টুন ও ব্যানার। ‘খালেদা জিয়ার মূলমন্ত্র, উদ্ধার করো গণতন্ত্র’ এই মুহূর্তে দরকার, খালেদা জিয়ার সরকার-এই ধরনের স্লোগান সংবলিত ব্যানার জনসভায় আগতদের নজর কাড়ে। দুপুরের মধ্যেই মূল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়াও পূর্বে মত্স্যভবন ও এর আশপাশে উত্তরে রূপসী বাংলা হোটেল, পশ্চিমে শাহবাগ মোড় এবং দক্ষিণে টিএসসি চত্বর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঢাকা মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকেও নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দেয়। বেলা পৌনে ২টায় জনসভা শুরু হলেও খালেদা জিয়া মত্স্য ভবনের সড়ক দিয়ে প্রবেশ করেন বিকাল ৩টায়। জনসভার ভিড় ঠেলে মূল মঞ্চে পৌঁছতে আধাঘণ্টা সময় লেগে যায় তার। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জনসভা পরিচালনা করেন প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীম। এতে আরও বক্তব্য দেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর, বরকতউল্লাহ বুলু, মো. শাজাহান, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, জয়নুল আবেদিন, শওকত মাহমুদ, আমান উল্লাহ আমান, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হারুনুর রশিদ, হাবিব-উন নবী খান সোহেল, সাইফুল আলম নীরব প্রমুখ। দীর্ঘ এক ঘণ্টার বক্তব্যে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ও ঐক্যের রাজনীতি করতে চাই। আলাপ আলোচনা ছাড়া কোনোভাবেই এ পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সংসদে থাকুক আর বাইরে থাকুক সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ ঘরে ঘরে কান্নার আহাজারি। এই সরকারের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চায়, পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তন হতে হবে ভোটের মাধ্যমে। সে জন্য মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। এ সময় তিনি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে পারবেন, ভোট দিতে পারবেন। তখন উপস্থিতি নেতা-কর্মীরা হাত তুলে সমস্বরে বলেন, ‘না’। নতুন ইসির উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আপনি সরকারের অন্যায় আবদার মানতে পারেন না। অবাধ নির্বাচন করার দায়িত্ব আপনাদের। ইভিএম বন্ধ করতে হবে। সেনা মোতায়েন করতে হবে। নির্দলীয় সরকারের ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ বাহিনীও থাকবে, এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার গুণ্ডা বাহিনীর হাতে অবৈধ অস্ত্র। তারা মানুষ খুন করছে। সেনা না দিলে তারা কেন্দ্র দখল করে অত্যাচার চালাবে। এ দেশের মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে পরিবর্তনের জন্য ধানের শীষে ভোট দিয়ে দেখিয়ে দেবে যে জিয়াকে  ভোলেনি। তিনি আছেন মানুষের মনে। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু জনগণ সেটা মানতে রাজি নয়। কারণ, এরা কত অবিচার করেছে তা তারা জানে। তারপরও দেশের স্বার্থে আমি তাদের ক্ষমা করব। কারণ আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই। জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি করতে চাই। আলাপ-আলোচনা ছাড়া তা সম্ভব নয়। আমরা জবাবদিহিতামূলক সংসদ দেখতে চাই। সরকারি দল ও বিরোধী দল আলোচনা করে কোনো সমস্যা হলে তা সমাধান করবে।’ বিএনপি-প্রধান বলেন, আজকে দেশে বিচার বলে কিছু নেই। বিচার বিভাগ বলতে কিছু নেই। প্রধান বিচারপতিকে পর্যন্ত জোর করে অসুস্থ বানিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিদেশে এজেন্সির লোক পাঠিয়ে তাকে চাপ দিয়ে পদত্যাগপত্র নিয়ে আসা হয়। তিনি চেয়েছিলেন দেশে ফিরে আসতে। কিন্তু তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি কিছু সত্য কথা বলেছেন-এটাই তার অপরাধ। নিম্ন আদালতকে তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এখন উচ্চ আদালতকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘দেশের এত ক্ষতি করেছেন। সম্পদ লুট করেছেন। পিঠ বাঁচানোর জন্য ক্ষমতায় থাকতে হবে বলে যা ভাবছেন তা হবে না। আমরা সহিংসতার রাজনীতি করি না। আমরা আপনাদের শুদ্ধ করব। যে খারাপ কাজ করেন তা বাদ দিয়ে আপনাদের সত্যিকার অর্থে মানুষ বানাব। বিএনপি-প্রধান আরও বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেন সরকার আমাকে সপরিবারে দেশত্যাগ করতে বলেছিল, তাদের কথায় আমি সাড়া না দিয়ে বলেছি, আমি দেশত্যাগ করব না। আমি কখনো এ দেশ ছেড়ে যাব না। কারণ এ দেশের মাটিই আমার একমাত্র ঠিকানা। অন্য কোথাও আমার ঠিকানা নেই। এরপর সে সরকার আমার দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এক ছেলেকে পঙ্গু করে দিয়েছে। তাদের অত্যাচারের কারণে আরেক ছেলেকে চিরদিনের মতো আমি দুনিয়া থেকে হারিয়ে ফেলেছি।’ এ কথা বলেই সমাবেশ মঞ্চে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। বিদ্যুৎ, গ্যাস, চাল-ডালসহ সবকিছুর দাম বৃদ্ধির সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এ সরকার এ দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে। ধ্বংস করে দিয়েছে। এ সরকার ২০০৮ সালে কথা দিয়েছিল ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে। আজ ৭০ টাকা কেজি চাল খাচ্ছে কেন মানুষ।’ তিনি বলেন, ‘পিয়াজসহ তরিতরকারি, সবজির দাম ৭০-৮০ টাকার নিচে নয়। প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কৃষকের সার ও কীটনাশকের দাম ৫ গুণ বেড়েছে। ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তারা আজ ঘরে ঘরে বেকার তৈরি করেছে।’ এ সময় তিনি বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আগামীতে দেশের সব শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েকে চাকরির ব্যবস্থাসহ এক বছরের বেশি সময় যারা বেকার থাকবে- তাদের জন্য বেকার ভাতা চালু করারও প্রতিশ্রুতি দেন। শেয়ারবাজার ধসের প্রসঙ্গ তুলে বেগম জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এলেই শেয়ারবাজার লুট হয়। এর আগে কখনো শুনিনি সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের মানুষের টাকা আছে। আওয়ামী লীগ আসার পর ওই ব্যাংকে টাকা পাঠিয়েছে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা। মানুষের রক্ত চুষে টাকা চুরি করে বিদেশে পাঠিয়েছে। ২০১৫ সালে  পাঁচ হাজার কোটি ও গত ১০ বছরে সুইস ব্যাংকে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রতি পদে পদে দুর্নীতি করছে। দুদক কোনো মামলা বা কোনো তদন্ত করেনি। অথচ দুদক পড়ে আছে আমাদের পেছনে। তিনি আরও বলেন, ‘গত সাত বছরে ব্যাংক থেকে চুরি হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা কারসাজি করে পাচার করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো নিয়ে কোনো তদন্ত হয় না। কাউকে ধরা হয়নি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু ভোটারবিহীন সরকারের সমস্যা নয়, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, ইন্ডিয়া, চীনসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ সভাপতির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দেশে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন হবে না।’ ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সাল আওয়ামী লীগের বিদায়ের বছর।’ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সরকার নিজের হাতে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইবে।’ খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ আখ্যা দিয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘নেত্রী (খালেদা জিয়া) আপনি গণতন্ত্রের প্রশ্নে কখনো আপস করবেন না। খালেদা জিয়াকে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।

সর্বশেষ খবর