রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিরিজ ড্রোন হামলার ছক

পুলিশ হত্যার পর ভিডিও করে প্রচার, বহুতল ভবনে অন্তত ১০ কেজি ওজনের বোমা হামলা জঙ্গিদের

সাখাওয়াত কাওসার

সিরিজ ড্রোন হামলার ছক

রাজধানীতে একযোগে ড্রোন অ্যাটাকের পরিকল্পনা ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্যদের। শুধু তা-ই নয়, পুলিশ হত্যার পর এর ভিডিও প্রচার করার মতো গা শিউরে ওঠা পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। রয়েছে বিচারক হত্যার পরিকল্পনা। এ ছাড়াও রাজধানীর একাধিক বহুতল ভবন উড়িয়ে দেওয়ার মতো ধ্বংসাত্মক টার্গেট রয়েছে জঙ্গিদের। ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ডের জন্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। সম্প্রতি টাঙ্গাইল ও নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার সৈয়দ নূরুল হুদা মাসুম, মো. সম্রাট মিয়া, বিমানের ফার্স্ট অফিসার সাব্বির এনামসহ সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের কাছ থেকে এসব তথ্য আদায় করেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। মাসুম, সম্রাট ও সাব্বির এনাম আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

গত ১২ অক্টোবর টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তি দেন মো. সম্রাট মিয়া। এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সৈয়দ নূরুল হুদা মাসুম। তাদের জবানিতে আসা তথ্য রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। ৮ নভেম্বর ঢাকার মহানগর হাকিম মো. সারাফুজ্জামান আনছারীর আদালতে পাইলট সাব্বির এনাম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জঙ্গিরা যদি আদালতেই এমন জবানবন্দি দিয়ে থাকে তা সত্যিই উদ্বেগের। তারা গ্রেফতার হলেও তাদের অনুসারীদের অবস্থা কিংবা কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দারাই ভালো বলতে পারবেন।

র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মাহবুব আলম বলেন, র‍্যাব সৃষ্টির পর থেকে সবচেয়ে বেশি জঙ্গি আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে চলতি বছর। এরই মধ্যে জঙ্গিদের অনেক পরিকল্পনা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মাসুম জানান, ফেসবুকের মাধ্যমেই সে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে জীবন ইসলাম, ভাবুক তওহীদ নামের আইডির সঙ্গে চ্যাট করার মাধ্যমে সে একপর্যায়ে জঙ্গিবাদের গভীরে ঢুকে যায়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার জন্য টেলিগ্রাম অ্যাপস ব্যবহার করত তারা। কীভাবে অস্ত্র বানাতে হয়, কীভাবে বোমা বানাতে হয়— এগুলো বিস্তারিত লিখে দেওয়া হতো। জীবন ইসলাম নামের ব্যক্তিই তাকে জঙ্গি নেতা আবদুল্লাহর মিরপুরের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আবদুল্লাহ আমাদের ২/৩টি তেলের ড্রামে বিস্ফোরক দেখিয়েছিল। বাসায় থাকা অনেক ফ্রিজে বোমা রাখা আছে বলে জানিয়েছিল সে।

মাসুম বলেন, আবদুল্লাহ তাকে বলেছে, হলি আর্টিজান থেকে শুরু করে যত হামলা হয়েছে সব হামলার জন্য টাকা ও অস্ত্র সে সরবরাহ করেছে। ওই সময় আবদুল্লাহ আমাকে বলে, হলি আর্টিজানে হামলার জন্য ১৫ লাখ টাকা সে দিয়েছে। সে আমাকে আমার বাবার মাজারে (সৈয়দ আবুল হাসান চিশতি) হামলার জন্য বলেছিল।  মাসুম তার জবানবন্দিতে আরও উল্লেখ করেন, আবদুল্লাহ ও আবু শফি আল বাঙ্গালী নামের একজনের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। এর কারণ হলো, আবু শফির কাছে লোকবল চাইলে সে আবদুল্লাহকে না করে দিয়েছিল। হলি আর্টিজান ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় হামলার কারণে আবদুল্লাহর লোক কমে যাচ্ছিল। আবু শফি নামের লোকটি ‘ডন’ নামে একটি আইডি চালাত। ডনের ইচ্ছা ছিল চট্টগ্রামে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। তবে আবদুল্লাহর ইচ্ছা ছিল ঢাকায় ২০তলা ভবন উড়িয়ে দেওয়ার। মো. সম্রাট মিয়া তার জবানবন্দিতে ও অনলাইনে দাওয়াতুল ইসলামের মতাদর্শে উদ্বুব্ধ হওয়ার কথা স্বীকার করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শুক্রবার কুফরা জামান (সৈয়দ নূরুল হুদা মাসুম) এবং এমডি জীবন ইসলামের মাধ্যমে আবদুল্লাহর সঙ্গে তার বাসায় দেখা করেন। তখন আমির নির্বাচন নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। সেখানে থাকা অনেকের উদ্দেশে আবদুল্লাহ বলেছিল যারা মাঠে কাজ করে তারা আসল জিহাদি আর যারা অনলাইনে কাজ করে তারা আসল জিহাদি নয়। 

সম্রাট আরও জানান, কুফরা জামান বলেছিল সে ড্রোন বানাতে পারে। তার একটি ড্রোন ১০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক বহন করতে পারে। হামলার সরঞ্জামের বিষয়ে আলোচনার একপর্যায়ে আবদুল্লাহ বলেছিল, তার কাছে আত্মঘাতী ভেস্ট আছে। বাসাতেই রয়েছে ৫০০ লিটার পেট্রল। রাজধানীতে একযোগে ড্রোন হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। আবদুল্লাহর বাসার কাছে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বসবাস করেন। তাকে তুলে এনে জবাই করে ভিডিও করে পরে তা প্রচার করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। পাইলট সাব্বির এনাম তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কোনোভাবে বিমান ক্র্যাশ করানো যায় কিনা, সে বিষয়ে আবদুল্লাহর সঙ্গে পরিকল্পনা হয়েছিল। আবদুল্লাহ আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাদের ২/৪ জন ছেলেকে ফ্লাইং শিখিয়ে বিচারালয়সহ সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ছোট ছোট বিমান দিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালানো যায় কিনা। এ পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে বিমানের ফার্স্ট অফিসার শাহরান আলী, ক্যাপ্টেন (অব.) আতাউল কাইয়ুম ও ক্যাপ্টেন নওশাদের সঙ্গে তার কথাও হয়েছিল।

তিনি জবানবন্দিতে বলেন, বিমান দিয়ে কোনো স্থাপনায় আঘাত হানতে হলে তা অবতরণের সময় সম্ভব। কোনোক্রমে টেক অফের সময় সম্ভব নয়। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে টেক অফ করে তাত্ক্ষণিকভাবে ঢাকার কোনো স্থাপনায় আক্রমণ করা সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম, সিলেট বা রাজশাহী থেকে বিমান এনে ঢাকার কোনো স্থাপনায় অবতরণকালে আঘাত হানা সম্ভব। স্থাপনার উচ্চতা উপপাদ্য অনুযায়ী হিসাব করে আঘাত করা সম্ভব।

বিচার ব্যবস্থা ও সংবিধান নিয়ে জঙ্গিদের মন্তব্য উল্লেখ করে সাব্বির বলেন, দেশের সংবিধান আল্লাহর আইন ও শরিয়ত পরিপন্থী বলে মন্তব্য করতেন আবদুল্লাহ। তার কথা ছিল, এ জন্য এদেশের বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে হবে। যারা ইসলামবিরোধী কথা বলে, তাদের কোনো বিচার হয় না। রনবী, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করেন। এদের কোনো বিচার হয় না বলে, ২/৩ জন বড় বিচারককে মেরে ফেলতে হবে। তাহলে বিচার করার সাহসিকতা বিচারকরা হারিয়ে ফেলবেন।

জবানবন্দিতে সাব্বির উল্লেখ করেন, আবদুল্লাহ তাকে বার বার সিরিয়ায় যাওয়ার কথা বলেছিলেন। তাতে সাব্বির রাজি না হলে, দেশে কিছু করা যায় কিনা সে ব্যাপারে পরিকল্পনা নিতে বলেন। তখন আবদুল্লাহ বলে, আমি যে বিমানটি চালাই, সেটা নিয়েই সিরিয়া যেতে পারি। সাব্বির তাকে বলে, আমি যে বিমানটি চালাই, সেটি দুজনে মিলে চালাতে হয়, তাই একা কিছু করা সম্ভব নয়। তবে জরুরি হলে জীবনে একবার সম্ভব। আমি তাকে সিরিয়ার রুট প্ল্যান দিয়ে বলেছিলাম, তুরস্ক হয়ে সিরিয়া যাওয়া সম্ভব, সরাসরি সম্ভব নয়।

প্রসঙ্গত, গত ৫ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার মসিন্দা গ্রাম থেকে গ্রেফতার হয় মাসুম। এরপর ৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে গ্রেফতার হন সম্রাট। আর গত ২৬ অক্টোবর মিরপুরের বর্ধনবাড়ির কমলপ্রভা বাড়ি থেকে পাইলট সাব্বির এনামকে র‍্যাব গ্রেফতার করে। এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর কমলপ্রভা বাড়িতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী হামলায় শীর্ষ জঙ্গি নেতা আবদুল্লাহ, তার দুই স্ত্রী ফাতেমা ও নাসরিন, দুই সন্তান ওমর ও ওসামা এবং দুই সহযোগী নিহত হয়। এরই মধ্যে অনেকে গ্রেফতার হলেও মূলত এই তিনজনের কাছ থেকেই গোয়েন্দারা জানতে পারেন ভয়ঙ্কর সব তথ্য। তবে তাদের আরও অনেক মতাদর্শী দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর