শিরোনাম
সোমবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

শেষ নেই অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই সারা দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ছে সরকারি দলে

রফিকুল ইসলাম রনি

শেষ নেই অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নয় বছর শেষ হতে চলেছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই চলছে জোর প্রস্তুতি। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই দলটির তৃণমূল পর্যায়ে কলহ-কোন্দল বাড়ছে। জেলা ও উপজেলায় দলীয় কোন্দলের পরিণামে মারামারি, হানাহানি ও সংঘর্ষের ঘটনা এখন যেন ‘নিয়ম’ হয়ে গেছে। ক্ষমতার শেষ মুহূর্তে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হবিগঞ্জের বাহুবলে সংরক্ষিত আসনের এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়ার ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। প্রায় ৩০ জেলায় দলীয় কোন্দলে গত ছয় মাসে কমপক্ষে ২০ জনের প্রাণ গেছে। হামলা-মামলায় বাড়িছাড়া হয়েছেন বহু নেতা-কর্মী। এর ফলে তৃণমূলের সাংগঠনিক রাজনীতি অনেকটাই নাজুক হয়ে পড়েছে। প্রভাব ধরে রাখতে শেষ নেই অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের। দলীয় সূত্রমতে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়ার পরও তৃণমূল পর্যায়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অনেক নেতা-কর্মীই এখন ক্ষমতার সুফল হিসেবে ‘কী পাওয়ার কথা আর কী পেলাম’ এমন অঙ্ক কষছেন। এতে দলটিতে অন্তঃকোন্দল বাড়ছে। মন্ত্রী ও এমপিদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের দূরত্বও বাড়ছে। তৃণমূলের এমন পরিস্থিতিতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এতটাই উদ্বিগ্ন যে, তাদের শঙ্কা : বিরোধপূর্ণ জেলায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই হবে। বর্তমান এমপিদের সঙ্গে সাবেক এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশী অথবা উপজেলা চেয়ারম্যান, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এসব ঘটনা ঘটছে। তবে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা এসব ঘটনাকে ‘কোন্দল’ বলে মানতে নারাজ। তাদের মতে, এসব ঘটনা ‘বড় পরিবারের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি’। এগুলো ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ মাত্র।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে, এটি মনে হয় নীতিনির্ধারকরা ভুলে গেছেন। দলের যে লোকগুলো গত মেয়াদে সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, এখনো তারা সে জায়গাতেই আছেন। সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের সময়ও শেষ হতে চলেছে। দলের বঞ্চিতরা বঞ্চিতই থাকছেন। এর ফলে অনেক নেতা-কর্মী মনঃক্ষুণ্ন হয়ে সংগঠনের কাজে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন, আবার অনেকে বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। এতে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ধারা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

গত ১০ নভেম্বর হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার মিরপুরে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর ওপর হামলা হয়েছে। ওই সময় তিনি মিরপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজসংলগ্ন বেদেপল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের চেক হস্তান্তরের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, উপনির্বাচনে বিজয়ী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক তারা মিয়া এবং জেলা পরিষদ সদস্য সাহেদ মিয়ার নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়।

পুরান ঢাকার আজিমপুরে গতকাল আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। কর্মী সমাবেশকে কেন্দ্র করে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ সংঘর্ষ হয়। এ সময় এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের নেতা-কর্মীদের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। জানা গেছে, মহানগরী আওয়ামী লীগ আজিমপুরে পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টারে (ভিকারুননিসা স্কুলের পাশে) সদস্য সংগ্রহ অভিযান ও ১৮ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নাগরিক সমাবেশ সফল করার প্রস্তুতি সভা ডেকেছিল। সকালে কমিউনিটি সেন্টারের সামনের রাস্তায় কে বা কারা সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনের ময়লা ফেলে যায়। ময়লা দেখে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সমর্থকরা মেয়র সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। পাশেই ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়রের সমর্থক হিসেবে পরিচিত কাউন্সিলর আবু আহমেদ মান্নাফিকে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে আরেকটি কর্মসূচি। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উভয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ কয়েক রাউন্ড কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। প্রায় আধা ঘণ্টা চলে ওই সংঘর্ষ। কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থাকা অন্তত ২০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন উত্তেজিত নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে তিনটিতে আগুন দেওয়া হয়। মোটরসাইকেলগুলো দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীদের বলে জানা গেছে। ২৯ অক্টোবর রূপগঞ্জের কায়েতপাড়ার চনপাড়া বস্তির আধিপত্য নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন ও বিউটি আকতার কুট্টির সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে বিউটি আকতারের স্বামী হাছান মহরী গুরুতর আহত হন। ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ নভেম্বর তিনি মারা যান। আনোয়ার ও কুট্টি উভয়েই স্থানীয় এমপি গোলাম দস্তগীর গাজীর সমর্থক বলে জানা গেছে।

কাঞ্চন পৌর এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মিজানুরের ওপর হামলা হয় ১৪ নভেম্বর। তিনি এখন বনশ্রীর ফরাজি হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। গাজী গ্রুপের লোক হিসেবে পরিচিত তিনি। শ্রমিক লীগের নেতা জাহিদুলের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ।

১৩ এপ্রিল নোয়াখালীর হাতিয়ায় আওয়ামী লীগের দুুই গ্রুপের সংঘর্ষে নুর আলম নামে এক কর্মী নিহত হয়েছেন। সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর সমর্থক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন চেয়ারম্যানের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর আগে প্রতিপক্ষের হামলায় মহিউদ্দিনের ভাই যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য আশরাফ উদ্দিন নিহত হন।

৭ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের বাখইলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চেয়ারম্যান কেরামত উল্লাহ ও সাবেক চেয়ারম্যান বখতিয়ার রহমানের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে বিল্লাল ও এনামুল নামে দুই আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন।

৩০ মে পাবনার বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আলিম খাঁ নামে এক কর্মী নিহত হন। পৌর ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে স্থানীয় আলিম খাঁ ও শফি হোসেনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। ১১ আগস্ট শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে যুবলীগ নেতা ইকবাল হোসেন মারা যান। রাজনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকির গাজী ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি দাদন মীরবহরের সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

২৯ মার্চ সাভারের আশুলিয়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রহিম নিহত হন। পাথালিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেনের কর্মীদের সঙ্গে পাথালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান পারভেজ দেওয়ানের কর্মীদের মধ্যে এ সংঘর্ষ ঘটে।

১৮ জুলাই কুষ্টিয়ার মিরপুরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী শাহীন নিহত হন। ৯ জুলাই বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে এমপির সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের জেরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষে ফারুক সরদার নামে এক নেতা নিহত হন। স্থানীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যান চেয়ারম্যান আলতাফ সরদার ও সহযোগীরা। পূর্বশত্রুতার জেরে সাবেক চেয়ারম্যান বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা জামাল মোল্লার লোকেরা এই হামলা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে মাগুরার শালিখায় প্রতিপক্ষের হামলায় আবদুল জলিল নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী মারা গেছেন। ১৪ নভেম্বর ফরিদপুরের সালথায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে জিয়াউর রহমান নামে এক কর্মী নিহত হন।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কোন্দলে জর্জরিত সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা জেলা, রাজশাহী জেলা, নাটোর, নওগাঁ, বরিশাল মহানগর, ভোলা, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ। এসব জেলায় মাঝেমধ্যেই অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ খবর