বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রংপুর সিটি ভোটে যত ফ্যাক্টর

আসিফকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন রাঙ্গা, তবুও মোস্তাফিজ চাঙ্গা বিএনপির প্রার্থী বাবলা, আবারও মেয়র হতে চান ঝন্টু

শফিকুল ইসলাম সোহাগ ও শাহজাদা মিয়া আজাদ, রংপুর থেকে

রংপুর সিটি ভোটে যত ফ্যাক্টর

আগামী ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন। হাওয়া বইছে রংপুরজুড়েই। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রংপুর সিটি। প্রথমবারের মতো রংপুরে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অন্যরকম আমেজ বিরাজ করছে। রংপুরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ বনাম জাতীয় পার্টিতে। এ সিটিতে আবারও জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চান আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। সিটির পর তিনিই প্রথম নগরপিতা। ওই নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫টি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জাতীয় পার্টির নেতা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। এবার রংপুরে তার অবস্থাও ভালো। দলও তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। তবে বিপত্তিটা হচ্ছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ। তাকে দাঁড় করিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। আবার জাতীয় পার্টির আরেক নেতা কে এম আবদুর রউফ মানিকও নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছেন। এরই মধ্যে বিএনপি তাদের সেই পুরনো প্রার্থী কাওসার জামান বাবলাকে মনোনয়ন দিয়েছে। তবে এই সিটিতে বিএনপির প্রার্থী অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলে ভোটাররা মনে করছেন।

ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি আধুনিক সিটি গড়তে যোগ্য ব্যক্তিকেই চান নাগরিকরা। তবে গত পাঁচ বছরে যানজট, বেহাল সড়ক আর ফুটপাথ দখলের মতো নানা বিষয় ভাবিয়ে তুলছে নাগরিক সমাজকে। তরুণ-বৃদ্ধ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ভাবনার জায়গায় এখন নির্বাচনে নেতৃত্ব ঘিরে। রংপুর সিটি করপোরেশনে অভিভাবক কে হচ্ছেন— তা নির্ভর করছে এলাকার নানান শ্রেণিবিন্যাসের ভোটারের ওপর। নানা ফ্যাক্টরও কাজ করছে ভোটে। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪।

আসিফ-মানিক জাপা প্রার্থীর চ্যালেঞ্জ : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাসস্থান রংপুরে হওয়ায় এই এলাকাকে জাপা নেতা-কর্মীরা লাঙ্গলের ঘাঁটি বলে দাবি করেন। নিজের এলাকায় বিজয় ছিনিয়ে আনতে এরশাদ সবার আগে প্রার্থী ঘোষণা করেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে। কিন্তু এরশাদের ভাইপো দলের যুগ্ম-মহাসচিব হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ এবং দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আবদুর রউফ মানিক নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শাহরিয়ার আসিফ জানিয়েছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবেন। অবশ্য জাতীয় পার্টি থেকে জানানো হয়েছে, আসিফ মনোনয়ন প্রত্যাহার না করলে তাকে বহিষ্কার করা হবে। ‘এরশাদের ঘাঁটি’ হিসেবে খ্যাত মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার পক্ষে লাঙ্গল প্রতীকের একটি অবস্থান তৈরি হলেও আসিফ-মানিক নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে ফল জাতীয় পার্টির ঘরে নাও যেতে পারে।

চ্যালেঞ্জ ৬০ হাজার হিন্দু ভোট : রংপুর সিটিতে হিন্দুধর্মাবলম্বী ভোট ৬০ হাজারের বেশি রয়েছে বলে দাবি করেছেন জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। এই সম্প্রদায়ের ভোটার স্বাধীনতার পর থেকে নৌকায় ভোট দেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে সবাই যে নৌকার সমর্থক নন তা বিগত দিনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দেখা গেছে। এবারের রসিক নির্বাচনে এই ভোটাররা যেদিকে ঝুঁকে পড়বেন সেই প্রার্থীর ভোটের পাল্লা ভারী থাকবে। এই ভোটারদের সমর্থন আদায়ে সব প্রার্থী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

হেফাজত-জামায়াতের ভোট পাচ্ছেন কারা? : সারা দেশের মতো রংপুরেও একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে হেফাজতে ইসলামের। হেফাজত নিজস্ব ব্যানারে নির্বাচনে অংশ না নিলেও তারা কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন বলে সংগঠনটির স্থানীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন। একইভাবে জামায়াতে ইসলামীরও এখানে বড় ভোটব্যাংক রয়েছে। ২০-দলীয় জোটের অংশীদার হিসেবে জামায়তের ভোটাররা বিএনপি প্রার্থীকে সমর্থন ও ভোট দেবেন এমনটাই আভাস পাওয়া যাচ্ছে দলটির নেতা-কর্মীদের কথায়।

কার সঙ্গে অবাঙালিরা? : স্বাধীনতার আগ থেকে নগরের বর্তমান ২৬, ২৭ ও ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে বেশিসংখ্যক অবাঙালি বসবাস করে আসছেন। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডেও কিছু অবাঙালি রয়েছেন। সব মিলিয়ে ১৫ হাজারের বেশি অবাঙালি ভোটার রয়েছেন। নির্বাচন এলেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ প্রতিটি দলের প্রার্থীরা তাদের সমর্থন ও ভোট আদায়ে তৎপরতা চালান। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। অবাঙালিদের সংগঠন এসপিজিআরসির কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘সিটিতে ১৫ হাজারের বেশি ভোটার রয়েছে আমাদের। নির্বাচন এলেই আমাদের ভোট নেওয়ার জন্য প্রার্থীরা জোর তদবির চালান। নানান প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এবার আমরা উন্নয়নমুখী যোগ্য প্রার্থীকেই বেছে নেব।’

পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার বেশি : পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৬ আর নারী ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন। পুরুষ ভোটারের পাশাপাশি নারী ভোটারদেরও গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রার্থীরা। এই লক্ষ্যে মেয়র প্রার্থীরা নারীদের টিম পাঠিয়ে ঘরে ঘরে ভোট চাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। নারীদের নিয়ে পৃথক নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করছেন প্রার্থীরা।

প্রার্থীদের টার্গেট ৩০ ভাগ এলিট ভোট : নির্বাচন ঘিরে সিটি করপোরেশনের এলিট ভোটাররাও বসে নেই। তারা বলছেন, নির্বাচনে প্রতীকের সঙ্গে প্রার্থীর যোগ্যতাও বিবেচনা করবেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির রংপুর জেলা সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুল ওয়াহেদ মিয়া জানান, ‘আবেগতাড়িত হয়ে নয়, রসিক নির্বাচনে আমরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে এমন প্রার্থীকেই বছে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি।’

মেয়র ঝন্টুর পদত্যাগ : রংপুর সিটি করপোরেশনের (রসিক) মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু পদত্যগ করেছেন। মেয়রের একান্ত সচিব রাশেদুল ইসলাম জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় মেয়রের পদত্যাগপত্র স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন নির্বাচন আইন অনুযায়ী কোনো মেয়র একই পদে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তাকে পদত্যাগ করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। আজ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় রসিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঝন্টুকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রসিকের প্রথম নির্বাচনে ঝন্টু মেয়র নির্বাচিত হন।

বিএনপির মনোনয়ন পেলেন বাবলা : রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে কাওসার জামান বাবলাকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। বাবলা রংপুর মহানগর বিএনপির সহসভাপতি। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম মিজু বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘সোমবার রাতে কেন্দ্রীয় কমিটি বাবলাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়। এ-সংক্রান্ত চিঠি গতকাল সকালে আমরা হাতে পেয়েছি।’ বাবলাও মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রসিকের প্রথম নির্বাচনেও বাবলা মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।

আরও দুই মেয়র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা : সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন আজ। মেয়র পদে ১৩ জন মনোনয়নপত্র নেন। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত জমা দিয়েছেন পাঁচজন। তারা হলেন জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, স্বতন্ত্র জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের এ টি এম গোলাম মোস্তফা বাবু এবং স্বতন্ত্র আবদুল মজিদ বীরপ্রতীক ও সুইটি আনজুম।

মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন আজ : ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন আজ। বাছাই ২৫ ও ২৬ নভেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৩ ডিসেম্বর। এবার এই নির্বাচনে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৬ ও মহিলা ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন। ১৯৬ কেন্দ্রের ১ হাজার ১৭৭টি কক্ষে ভোট গ্রহণ করা হবে। রিটার্নিং ও রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার জানান, ‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আচরণবিধির ব্যাপারে কোনো প্রার্থীকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

সর্বশেষ খবর