বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নগরীতে হঠাৎ বেড়েছে ছিনতাই

হয়রানির ভয়ে থানায় যেতে চান না ভুক্তভোগীরা

সাখাওয়াত কাওসার

হঠাৎ করে রাজধানীতে বেড়ে গেছে ছিনতাই। রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ছিনতাইকারী চক্র। ছিনতাকারীদের হাত থেকে রেহাই মিলছে না খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদেরও। গতকাল ভোরেই ঘটল এমন এক ঘটনা। রিকশাযোগে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে শাহজাহানপুরের বাসায় ফেরার পথে মৌচাক এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মাহবুবুল হক (৪৫)। পরে আহত অবস্থায় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। মাহবুব ডিবির পশ্চিম বিভাগে কর্মরত। কেবল মূল্যবান সামগ্রী কিংবা ছোটখাটো হামলা নয়, ছিনতাইকারীদের থাবায় মাঝেমধ্যেই ঝরছে সাধারণ মানুষের জীবন। একের পর এক ঘটনায় ছিনতাইকারী আতঙ্কে ভুগছেন নগরবাসী। এত অঘটনের পরও রাজধানীতে বেশিরভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় কোনো মামলা হয় না। এর পেছনে ভুক্তভোগীদের যুক্তি হলো— মামলা করলে উল্টো পুলিশি হয়রানিতে পড়তে হয় তাদের। মামলার কারণে বাধ্য হয়ে আবার যেতে হয় আদালত পর্যন্ত। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ইউএনডিপির পুলিশ রিফর্ম প্রোগ্রামের খবর কী? এটা কবে শেষ হবে? ওই প্রকল্পের মাধ্যমে কলোনিয়াল টাইপের পুলিশকে ডেমোক্র্যাটিক পুলিশে রূপান্তরিত করার কথা। কলোনিয়াল টাইপের পুলিশিং পরিবর্তন না হলে ভুক্তভোগীরা হয়রানির কবলে পড়বেন— এটাই স্বাভাবিক। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহ্মুদ খান বলেন, ছিনতাই ঠেকানো র‌্যাবের কাজ নয়। এরপরও আমরা সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে মাঝেমঝেই অভিযান চালিয়ে থাকি। র‌্যাব সদস্যরা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসে। তবে দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যেই ছিনতাইকারীরা জামিনে বের হয়ে ফের আগের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। গত ২ নভেম্বর বেলা আড়াইটার দিকে মিরপুর-২ নম্বরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সামনে আশিস দুগ্গাল নামের ভারতীয় এক নাগরিক ছিনতাইয়ের শিকার হন। আশিস দুগ্গাল ও তার বাংলাদেশের সহকর্মী আরিফুল ইসলাম মিরপুর-২ নম্বরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন  থেকে মিরপুর-১ নম্বরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি বাইকে চড়ে দুই ছিনতাইকারী আশিসের ব্যাগ নিয়ে টেকনিক্যালের দিকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর-২৭) করেছেন আশিস। ব্যাগে একটি ল্যাপটপ, ল্যাপটপ চার্জার, মোবাইল চার্জার, একটি হার্ড ডিস্ক, মূল্যবান তথ্যসংবলিত চারটি পেনড্রাইভ ছিল। গত ৮ অক্টোবর সকালে রাজধানীর টিকাটুলীর কে এম দাস লেনের ১২/২ নম্বর বাসা থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে হুমায়ুন সাহেবের বাড়ির সামনে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবু তালহা খন্দকার। ছিনতাইকারীরা তার মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। একই স্থানে সাদিয়া নামের এক স্কুল শিক্ষিকা এবং তার ভাই সানির মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করে ছিনতাইকারীরা। এ সময় তালহা সাহস করে এক ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরে চিৎকার দেয়। কিন্তু আশপাশের কেউ এগিয়ে না আসায় ছিনতাইকারীরা তালহাকে উপর্যুপরী ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। ঢাকা  মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর তালহার মৃত্যু হয়।  স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কে এম দাস লেনসহ টিকাটুলীর আর কে মিশন রোড, অভয় দাস লেন,  গোপীবাগ রেল গেট, হুমায়ুন সাহেবের রেল গেটসহ পুরো এলাকাজুড়ে বহুদিন ধরেই ছিনতাইকারীদের  দৌরাত্ম্য। প্রায় প্রতিদিনই এসব এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এই ছিনতাইকারী গ্রুপের ১০/১২ জন সদস্য তিন বছরে শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের হাতে আহত হয়েছে কমপক্ষে ২০ জন। এ ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে একই ছিনতাইকারী গ্রুপ ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে পরপর দুই দিন দুটি ছিনতাই করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যমতে, গত দুই মাসে রাজধানীতে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আহত হয়ে এখানে চিকিৎসা নিয়েছে কমপক্ষে ৪৯ জন। এর মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার একজন মাঠ কর্মকর্তাও ছিলেন। তবে প্রকৃতপক্ষে ছিনতাইয়ের ঘটনা এর চেয়ে কয়েক গুণ  বেশি। কারণ অনেকে ঝামেলা এড়াতে ঢাকা মেডিকেল বা থানা পর্যন্ত যান না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত দুই মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনায় যে সব থানা এলাকার মানুষ চিকিৎসা নিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, কাফরুল, শাহআলী, দারুস সালাম, কলাবাগান,  শেরেবাংলা নগর, ভাসানটেক, যাত্রাবাড়ী, লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানা।  পুলিশের ভাষ্য মতে, ছিনতাই প্রতিরোধে ঢাকার অনেক সড়ক ও বাড়িতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা সিসিটিভি বসানো হয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাবের প্যাট্রল ডিউটি, ফুট প্যাট্রল ও সাদা পোশাকে ডিউটির পাশাপাশি ছদ্মবেশে  গোয়েন্দা নজরদারিও করা হচ্ছে। তবুও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েই চলছে। জানা গেছে, গোলাপবাগ থেকে টিকাটুলী এবং গোপীবাগ এলাকায় আসলাম গ্রুপ সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ও ভয়ঙ্কর। এ ছাড়া মকবুল গ্রুপের কামাল, করিম, কালাম, পলাশসহ আরও কয়েকজন টিকাটুলী থেকে মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনের এলাকা হয়ে মতিঝিল এলাকায় ছিনতাই করে। তবে গোটা রাজধানীতে অন্তত দেড় শতাধিক ছিনতাইকারী চক্র রয়েছে। এদের অনেকেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। মাদকের টাকা জোগাড় করতেই এরা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী  চৌরাস্তা পর্যন্ত এলাকায় সক্রিয় সোর্স হানিফের ছিনতাইকারী গ্রুপ। এই গ্রুপে আছে ডিব্বা রাব্বি,  মোহাম্মদ আলী, রিয়াজ, সুম, মিঠুসহ আরও কয়েকজন। আর যাত্রাবাড়ীর অলিগলিতে ছিনতাই করে  সোর্স রাজুর নেতৃত্বে দিদার, খাকি বাবু, জাহাঙ্গীর, মিলনসহ বেশ কয়েকজন। টিকাটুলী থেকে রাজধানী মার্কেট হয়ে দয়াগঞ্জ পর্যন্ত সক্রিয় আরও দুটি গ্রুপ। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। সম্প্রতি ধানমন্ডি ২৮ নম্বর সড়কে সন্ধ্যার ছিনতাইয়ের শিকার হন পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের চিকিৎসক ডা. অনুপ সরকার অপু। রিকশায় করে মোহাম্মদপুর মেটার্নিটি হাসপাতালে যাওয়ার সময় দুটি মোটরসাইকেলে করে চার যুবক ফিল্মি স্টাইলে রিকশা থামিয়ে তার সঙ্গে থাকা ব্যাগটি নিয়ে চলে যায়। ওই ব্যাগে তার দামি স্মার্ট মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও তার মায়ের চিকিৎসার কাগজপত্র ছিল। এ ব্যাপারে অপু বলেন, আমি জানতে পেরেছি ওরা নাকি ধনাঢ্য পরিবারের স্থানীয় বখে যাওয়া যুবক। পুলিশি হয়রানির কথা চিন্তা করে ইচ্ছে করেই থানায় কোনো অভিযোগ দেইনি। ভুক্তভোগীদের মতে, এসব এলাকার ছিনতাইকারীচক্র  বেশিরভাগ সময়ে ভোরে এবং সন্ধ্যার দুই এক ঘণ্টা পর ছিনতাই করে। ভোরে রাস্তাগুলো থাকে ফাঁকা। টহল পুলিশ যখন ডিউটি বদল করতে যায়, ঠিক সেই সময় রাস্তায় নামে ছিনতাইকারীর দল। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ তৎপর আছে। নগরীকে নিরাপদ রাখতে সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা  নেওয়া হচ্ছে। পুলিশি টহল, তল্লাশি, ফুট প্যাট্রল,  মোটরসাইকেল প্যাট্রল ডিউটি চলছে। বিভিন্ন এলাকা সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, কেউ থানায় গিয়ে পুলিশি হয়রানির শিকার হলে এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে অবহিত করতে হবে। তাহলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব।

সর্বশেষ খবর