শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৮৪

চাবি খুলে দিল জোড়া খুনের রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

চাবি খুলে দিল জোড়া খুনের রহস্য

অ তে অজগর, অজগর ওই আসছে তেড়ে। আ তে আম। আমটি আমি খাবো পেড়ে। হারিকেনের আলোতে চার বছরের শাম্মিকে পড়াচ্ছেন তার মা। হঠাৎ শাম্মি তার মায়ের কাছে বায়না ধরে—আম্মু আম খাবো। আচ্ছা! তোমার বাবাতো এখনই বের হলো। আগে কেন বলোনি। তোমার বাবা আসুক। কালকে আম কিনে দিতে বলব। এবার পড়। মেয়েকে বলে তার মা। ঠাস ঠাস! হঠাৎ গুলির বিকট শব্দ।! মা-মেয়ে কেঁপে ওঠে। ভয়ে মেয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। আবার শব্দ! ঠা ঠা ঠা ! মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মা চিৎকার করে বলে, আল্লাহ রহম কর। এত বিকট শব্দ মনে হচ্ছিল তাদের উঠানেই গোলাগুলি হচ্ছে। গুলি থেমে গেছে। কিন্তু শাম্মির কান্না থামছে না। মা তাকে নির্ভয় দেন। আদর করে। হঠাৎ শাম্মির বাবার কথা মনে পড়ে তার। আরে! উনি তো মাত্রই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল! গুলি কোথায় হলো! তবে কি ওর উনার কিছু হলো? অজানা আতঙ্ক মনে ভর করে। মেয়েকে নিয়েই ঘড় থেকে দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে। মেয়ের হাত ধরে ছুটে চলে সামনের রাস্তার দিকে। গোলাগুলির কারণে জনমানবহীন সড়ক। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তার মাঝখানে দুটি মোটরসাইকেল দেখতে পান শাম্মির মা। পাশেই কেউ পড়ে আছে সেখানে। হাত-পা ছুড়ে কাতরাচ্ছে। আলো আঁধারে তারা ঠিকমতো দেখতে পারছে না। মা-মেয়ে চলে এসেছে। আরে একি! এ তো শাম্মির বাবা! গগনবিদারি চিৎকার। দুহাত আকাশের দিকে তুলে বলছেন, আমার এত বড় ক্ষতি কে করল!”শাম্মি তার বাবার রক্তাক্ত দেহের ওপর আছড়ে পড়ে। বাবা তোমার কী হয়েছে, রক্ত কেন? অবুঝ শিশুর কান্না। তখনো বেঁচে আছেন শাম্মির বাবা। লোকজন চলে এসেছে। ধরাধরি করে তারা কাছের হাসপাতালে নিচ্ছে। এ সময় সবার চোখে পড়ে, মোটরসাইকেলের পাশে পড়ে আছে আরও এক যুবকের রক্তাক্ত দেহ। অপরিচিত। জিন্স প্যান্ট আর টি শার্ট পরা। তার দম নেই। পুলিশ আসে। যুবকের লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। হাসপাতাল থেকে আধা ঘণ্টা পর খবর আসে গুলিবিদ্ধ শাম্মির বাবা আর বেঁচে নেই। তিনিও মারা গেছেন। মাদারীপুরের রাজইর উপজেলার মিল্কভিটা সড়কে খুন হন টেকেরহাট আলিয়া মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মাওলানা বাশার। সন্ধ্যায় নামাজ পড়েই বাসায় ফিরবে বলে বাশার তার স্ত্রী আর সন্তানের সঙ্গে কথা বলে বাসা থেকে বের হন। বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আগে থেকে ওতপেতে থাকা অস্ত্রধারীরা তাকে গুলি করার পর এলোপাতাড়িভাবে কোপায়। হাসপাতালে নেওয়ার কিছু সময় পর তার মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরও খুন হয় কিলার গ্রুপের একজন।

২০১৪ সালের ৩১ মে শনিবার সাড়ে ৮টার দিকে রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট বন্দরের মিল্কভিটা সড়কের জোড়া খুনের পর পুলিশ ও গোয়েন্দারা মাঠে নামে। এ ঘটনার ব্যাপারে বাশারের ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত করতে যেয়ে তেমন কিছু খুঁজে প্রথমে পায় না। পুলিশ কোনো ভাবেই দুটি খুনের ঘটনা এক সুতোয় বাঁধতে পারছে না। পুলিশ জানতে পারে মাওলানা আবুল বাশারের সঙ্গে আরও একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি যে খুন হয়েছে, তার নাম বেলাল শেখ। কিন্তু বেলাল শেখ পুলিশের তালিকাভুক্ত পেশাদার অপরাধী। আলিয়া মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা আবুল বাশারের সাথে একসঙ্গে কেন খুন হবে, এটি তাদের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। বেলাল শেখের পকেট থেকে একটি আবাসিক হোটেলের রুমের চাবি পাওয়া যায়। এজাহারে বাদী ঘটনার পিছনে ইউপি নির্বাচন রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। পুলিশ সেদিকটাই তদন্ত করতে থাকে।

গোয়েন্দারা বেলাল শেখের পকেট থেকে পাওয়া চাবি নিয়ে হোটেলে যায়। হোটেলের রুম থেকে একটি কাগজের টুকরা উদ্ধার করে। তাতে চারটি ফোন নম্বর পায়। একটি নম্বরে ফোন করে ওই এলাকা থেকে মহসীন নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে। জেরার মুখে সে ঘটনার সঙ্গে জরিত বলে স্বীকার করে। কিন্তু নির্দেশদাতার নাম সে জানে না বলে পুলিশকে জানায়। পুলিশ নিশ্চিত হয় সে ভাড়াটে খুনি। এদিকে র?্যাব-২-এর এক সদস্যের কাছে একটা ফোন আসে। মাদারীপুরের তার এক পরিচিত লোক ফোন করে জানায়, তার এক বন্ধু শাহীনকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে পার করে দিতে হবে। এ জন্য তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে। র?্যাবের সদস্যকে পুরো ঘটনা খুলে বলে। র?্যাবের এই সদস্য রাজি হয়। তিনি তার পদস্থ কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি জানান।

মহাখালীর একটি হোটেলে সে অপেক্ষায় থাকবে। তার নাম শাহীন। জোড়া খুনের আসামি সে। দিনক্ষণ ঠিক করে র?্যাব-২ প্রস্তুতি নিয়ে যায় ওই হোটেলে। যেয়ে শাহীনকে পায়। তত্ক্ষণাৎ তাকে গ্রেফতার করে মাদারীপুর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। মাদারীপুরে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর জেরা করা হয়। সে ঘটনার কথা স্বীকার করে। গোয়েন্দারা জানতে পারে, মাত্র তিন লাখ টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে খুনিরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ইউপি নির্বাচনের জের ধরে এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হন আবুল বাশার। খুনের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারায় মতভেদ হওয়ায় একই সময় খুন হন ভাড়াটে সন্ত্রাসী বেল্লাল শেখ। হত্যাকাণ্ডের আগে সন্ত্রাসীদের ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয় থাকা-খাওয়ার জন্য। খুনিরা ২৫ দিন ধরে বাশারকে অনুসরণের পর হত্যা করতে পারে।

সর্বশেষ খবর