শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ফেরতে অস্পষ্টতা

জাতিসংঘ বলল রাখাইনে পরিবেশ নিরাপদ হয়নি, অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষরকে মিয়ানমারের স্টান্টবাজি বলছে আন্তর্জাতিক সংস্থা, শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা ফেরতে অস্পষ্টতা

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে একটি অ্যারেঞ্জমেন্ট বা ব্যবস্থা স্বাক্ষরের পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। দূর হয়নি কবে কোন পদ্ধতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন হবে তা নিয়ে সৃষ্ট সংশয়। মিয়ানমারের ওপর এখনো আস্থা রাখতে পারছেন না কেউই। আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে শুরু করে দেশীয় কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ দেখছেন না আশার আলো। অবশ্য মিয়ানমারের সঙ্গে ঠিক কী ধরনের সমঝোতায় বাংলাদেশ পৌঁছেছে সেটাও স্পষ্ট নয়। অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী আজ ঢাকায় সংবাদ সম্মেলেন দুই দেশের একমত হওয়া বিষয়গুলো স্পষ্ট করবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে নেপিদোতে একটি সমঝোতা স্মারক-এমওইউ স্বাক্ষরের প্রস্তুতিই ছিল বাংলাদেশের। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া শুরু করা এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে আগ্রহী ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কিছুতেই তৃতীয় কোনো পক্ষকে সম্পৃক্ত করতে রাজি না হওয়ায় কোনো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেনি বাংলাদেশ। পরিবর্তে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের জন্য একটি টাইমফ্রেম  বেঁধে দিয়ে ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্ব্বাক্ষর করা হয়। এদিকে গতকাল চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান। সেখানে তিনি রাখাইন ইস্যুতে আলোচনা করেছেন বলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন।

মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে এই অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষরকে ‘স্টান্টবাজি’ বলে অভিহিত করেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শীর্ষ এক কর্মকর্তা। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটির শরণার্থী অধিকারবিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভস্ম হয়ে যাওয়া গ্রামগুলোতে মিয়ানমার এখন তাদের উন্মুক্ত বাহুডোরে ফেরত নেবে এমন ধারণা হাস্যকর। এটি মানুষকে ভোলাতে একটি স্টান্টবাজি। এতে সমর্থন না দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের এটা স্পষ্ট করা উচিত  যে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া  কোনো প্রত্যাবাসন হবে না। ফেরত যাওয়া ব্যক্তিদের ক্যাম্পে রাখার ধারণার ইতি টানতে হবে। এ ছাড়া জমিজমা  ফেরত দেওয়া এবং ধ্বংস করা বাড়িঘর, গ্রাম পুনর্গঠনসহ আরও অনেক শর্ত দিতে হবে। বার্মিজ সেনাবাহিনী যদি  রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কয়েক দশকের নির্যাতন ও  বৈষম্যের চর্চাকে পাল্টানোর বিরাট কাজটা শুরু না করে, তাহলে স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে বহু রোহিঙ্গার মধ্যে পর্যাপ্ত আস্থা তৈরি করা কঠিন হবে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরার মতো পরিস্থিতি রাখাইনের উত্তরাংশে এখনো হয়নি। ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র আদ্রিন এডওয়ার্ড শুক্রবার  জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সম্মতিপত্রে কী আছে- তা এখনো তারা দেখেননি। তবে সহিংসতার শিকার হওয়া মিয়ানমারের ওই জনগোষ্ঠীর রাখাইনে ফেরার বিষয়টি যেন  স্বেচ্ছায় এবং নিরাপদে হয়, তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অবশ্যই আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে এবং এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এএফপির রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্প্রতি স্বাক্ষরিত অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছে নব্বই দশকে দুই দেশের মধ্যে হওয়া একটি চুক্তির ভিত্তিতে যেখানে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রমাণে সক্ষম ব্যক্তিদের ফেরত নেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু রাখাইনের ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার প্রায় শতভাগই মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যাত। বছরের পর বছর ধরে তারা অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত। যারা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন তাদের অনেকেরই কোনো পরিচয়পত্রই নেই। তাহলে তাদের কেউ এই চুক্তির অধীনে মিয়ানমারে ফিরতে পারবেন না বলে শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো আহ্বান জানিয়ে এসেছে যে কোনো ধরনের প্রত্যাবর্তন চুক্তিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত থাকুক। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় মিয়ানমার বলেছে, তারা এমনটা চায় না। জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা চার লাখের মতো রোহিঙ্গা গত কয়েক দশক ধরে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে আছে। আর গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে নতুন করে দমন অভিযান শুরুর পর আরও সোয়া ছয় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত  পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাদের ফেরার পথ তৈরি করতে বৃহস্পতিবার নেপিদোতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের দফতরের মন্ত্রী কিয়া টিন্ট সোয়ে একটি অ্যারেঞ্জমেন্ট বা ব্যবস্থাপত্র স্বাক্ষর করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পর জাতিগত নিধন বলল অস্ট্রেলিয়াও : যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনকে ‘জাতিগত নিধন’র সমতুল্য বীভৎস অপরাধ আখ্যা দেওয়ার একদিন পর অস্ট্রেলিয়ার সরকারও প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হওয়া নৃশংসতাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলে আখ্যা দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র ফেয়ারফ্যাক্স মিডিয়াকে বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া বার বার বলে আসছে, গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধে দোষীদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

 আর আমরা জাতিগত নিধনযজ্ঞের খবর নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’

সর্বশেষ খবর