শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৮৫

অপারেশন বেয়নেট

মির্জা মেহেদী তমাল

অপারেশন বেয়নেট

দৌলতদিয়া (গোয়ালন্দ) থেকে খুলনাগামী তিতুমীর ট্রেনটি নির্দিষ্ট সময় স্টেশন ছাড়ল। ট্রেন ছুটছে। ধীরে ধীরে গতি বাড়ছে। ট্রেনটি ছুটছে আর দুলছে। ট্রেনের যাত্রীরাও দুলছেন। কেউ ঝিমুচ্ছেন। কেউ গল্পে মশগুল নিজেদের মধ্যে। সেদিন সামান্য বিলম্বে কুষ্টিয়া রেলস্টেশনে এসে পৌঁছায়। পোড়াদহ স্টেশনের পর ট্রেনটির গতি আরও বাড়ে। হঠাৎ ট্রেনের কামরায় একদল অস্ত্রধারী! মুখোশে মুখ ঢাকা। কেউ লুঙ্গি পরা, কেউ পায়জামা। ৪০ জনের এই দলের প্রতি সদস্যের হাতেই অস্ত্র। যাত্রীরা চিৎকার করে কেউ হাউকাউ করবা না। চুপচাপ বসে থাকো। অস্ত্রধারীরা কাউকে খুঁজছে। এই কামরা থেকে আরেক কামরা। প্রতিটি আসনের যাত্রীদের ভালোভাবে দেখে। কিন্তু কোথাও তাদের সেই লোকটি খুঁজে পায় না। ১৯৯০ সালে কুষ্টিয়ার হালশা স্টেশনে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কসাই সিরাজের নেতৃত্বে সেই ঘটনার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন বেয়নেট।’

প্রত্যক্ষদর্শী একজন পুলিশকে জানান, ‘যাত্রীদের মধ্যে কাকে যেন খুঁজে ফিরছে অস্ত্রধারীরা। প্রথমে মনে করেছিলাম ডাকাত নয় তো? ট্রেনে রক্ষীরা থাকে, ফলে দিনদুপুরে ডাকাত পড়বে সেটাও যুক্তি দিয়ে মেনে নিতে পারছিলাম না। আবার রেলরক্ষীদের না দেখে শঙ্কা জাগছিল। হালসা স্টেশনের আগে থেকেই ট্রেনের গতি শ্লথ হয়ে যায়। ভয় পাই এবার, কারণ হালসায় তিতুমীরের কোনো স্টপেজ নেই। কাছে টাকা ছিল, রেখে দিই মোজার মধ্যে। একপর্যায়ে ট্রেনটি থেমে যায়। কয়েকজন অস্ত্রধারী আমাদের কামরায় এসে চিৎকার করে বলে, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা চোর-ডাকাত নই। কিন্তু কেউ নড়াচড়া করতে পারবেন না। চুপ করে যে যার সিটে বসে থাকুন।” তারপর তারা ট্রেনের দরজা বন্ধ করে দেয়। কাকে যেন খুঁজতে থাকে এ কামরা থেকে সে কামরা পর্যন্ত। এক সময় হৈচৈ শুনে পাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অস্ত্রধারীরা এক ব্যক্তিকে টেনেহিঁচড়ে স্টেশনের এক প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। আর সেই লোকটি চিৎকার করছে। বলছে, “বাঁচাও বাঁচাও।” তাকে কাকুতি-মিনতি করতে দেখতে পেলাম। ইতিমধ্যে অস্ত্রধারীরা ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ায় সাহসী দু-এক জন যাত্রী দরজা খুলে বাইরে নেমেছেন। তাদের একজন এসে জানান, সিরাজের নেতৃত্বে এক ব্যক্তিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। লোকটিকে হয়তো তারা মেরে ফেলবে। সিরাজের নাম শুনে ভয়ে আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে যায়। স্টেশনের দিকে তাকাতেও পারিনি। কিন্তু ওই ব্যক্তির আর্তচিৎকার কানে এসে ভাসে। তাকিয়ে দেখি তার ওপর বেয়নেট চার্জ করা হচ্ছে। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসে। আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকি। একসময় হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটি চলা শুরু করে।’ ওই ব্যক্তি সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন আমি ঘুমাতে পারিনি। স্বপ্নের ভিতর যেন ওই ব্যক্তির আর্তচিৎকার শুনতে পেতাম।’

সিরাজের অপারেশন বেয়নেট ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত একটি হত্যাকাণ্ড।

পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, ফকির মোহাম্মদকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেদিন ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি দল নিয়ে সিরাজ কুষ্টিয়া রেলস্টেশন থেকে তিতুমীরে চেপে বসেছিল। তারা তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আগেই খবর পেয়েছিল ফকির মোহাম্মদ ওই ট্রেনে কুষ্টিয়া থেকে খুলনার দিকে পালিয়ে যাবে। ট্রেনে উঠেই প্রথমে তারা রেলরক্ষী বা জিআরপির কামরায় গিয়ে অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে। নির্দেশ দেয় তারা (রেলরক্ষী) যদি কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা চালায় তাহলে সব অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হবে। আরও জানায়, তাদের কাছে যে আগ্নেয়াস্ত্র আছে তা রেলরক্ষীদের অস্ত্রের চেয়ে আধুনিক এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। লোকবলেও তারা অনেক। জিম্মি রেলরক্ষীরা ওই হুমকির মুখে ভয় পেয়ে যায়। ফকির মোহাম্মদ আগেই বুঝেছিল যে ট্রেনে সিরাজের লোকজন উঠেছে। উদ্দেশ্য তাকে হত্যা করা। তাই সে নিজে রেলরক্ষীদের কামরায় গিয়ে তাকে রক্ষার আবেদন করেছিল। রক্ষীরা তাকে লুকিয়ে রাখে। ফলে সারা ট্রেন খুঁজেও যখন ফকির মোহাম্মদকে সিরাজের লোকজন পায় না, তখন চেন টেনে তারা হালসায় নেমে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। হালসা রেলস্টেশন থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে সিরাজের নিজ গ্রাম আমবাড়িয়া। নামার আগে তাদের সন্দেহ জাগে ফকির মোহাম্মদ রেলরক্ষীদের কামরায় লুকিয়ে নেই তো। তখন তারা সবাই এসে ওই কামরায় তল্লাশি চালায়। একটি সিটের নিচে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় ফকির মোহাম্মদকে খুঁজে পায়। জিআরপির কয়েকজন সদস্য ফকিরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অস্ত্র তাক করা হয় তাদের ওপর। হুমকি দেওয়া হয় অস্ত্র ছিনতাইয়ের। ফলে তাদের সামনে থেকেই সিরাজ বাহিনী ফকির মোহাম্মদকে নামিয়ে নিয়ে যায়। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সিরাজ বাহিনীর চলা ওই অভিযান বন্ধ করা কিংবা প্রতিরোধের সুযোগ যে ছিল না তা নয়। যদিও হালসা রেলস্টেশনটি মিরপুর থানার মধ্যে পড়ে, কিন্তু পাশেই কুষ্টিয়া সদর থানা। টেলিফোনের মাধ্যমে খবর দেওয়া হলে কুষ্টিয়া পুলিশের পক্ষে এত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে চলে আসা অসম্ভব ছিল না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর