সোমবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১০০

জেল ভেঙে পালানোর ভয়ঙ্কর ছক

মির্জা মেহেদী তমাল

জেল ভেঙে পালানোর ভয়ঙ্কর ছক

দেশের ভয়ঙ্কর এক অপরাধী জেলে। কনডেম সেলে। এরপরেও স্বস্তি নেই পুলিশের। কারাগারের ভিতরেই তাকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, ভয়ঙ্কর এই অপরাধী কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে পারে। ফাঁসি কার্যকর না করা পর্যন্ত কোনো স্বস্তি পাচ্ছে না পুলিশ। গোয়েন্দাদের কাছে নানা তথ্য আসতে থাকে। এর মধ্যে ভয়ঙ্কর তথ্যটি হলো, কনডেম সেলে আটক এই অপরাধীকে ছিনতাই করা হবে। কারাগারে বড় ধরনের হামলা হবে। বাইরে থেকে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে তাকে তুলে নিয়েই পালাবে। জেল হামলার জন্য প্রস্তুতিও তাদের শেষ। ইতিমধ্যে জেলের কনডেম সেলের পাথর দেয়ালের মধ্যে বন্দী সেই অপরাধী তার সহযোগীদের সঙ্গে দেখা করেছে। পরিকল্পনা মোতাবেক সব কিছু হচ্ছে। এসব তথ্যের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন রেড অ্যালার্টে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয় কারাগারের। কিন্তু সেই অপরাধী নিশ্চিত, তার পরিকল্পনা মতোই কাজ হবে। জেল ভেঙে পালাবেন তিনি। ১৯৮২ সালের ঘটনা এটি। জেলা পালানোর এই পরিকল্পনা নিয়েছিল গাল কাটা কামাল। কিন্তু গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে তার এই মিশন ফেল করে। পরে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে ঢাকা কারাগারে কামালের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে গোটা পুলিশ প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এই গাল কাটা কামাল ছিলেন সন্ত্রাসের মূর্তপ্রতীক। তবে তিনি গানও গাইতেন। যে হাতে তিনি হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন, সেই হাতেই তিনি অস্ত্র চালাতেন। লাশ ফেলতেন। কখনো নিজ প্রয়োজনে, কখনো ভাড়াটে হয়ে। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে গুলি করে খুন করতে যেমন ছিলেন পারদর্শী, তেমনি ধারালো অস্ত্রের ব্যবহারে দেহ থেকে মাথা আলাদা করতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। খুনের নেশায় মত্ত এই মানুষটির ভয়াবহ সব কর্মকাণ্ডে কাঁপত ঢাকা শহর। সর্বশেষ গ্রেফতারের পর গাল কাটা কামাল সব অপরাধের দায় একাই মাথা পেতে নেন। তিনি তার সব সহযোগীকে অভিযোগ থেকে সরিয়ে নেন। একাই সব ঘটনার জন্য দায়ী বলে আদালতকে জানায়। যে কারণে তার সহযোগীদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে এর বিনিময়ে কামাল তার সহযোগীদের বলেছিলেন, তাকে জেল ভেঙে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তার সহযোগীরাও তাতে রাজি ছিল। কামালকে ছিনিয়ে নিতে সারা দেশ থেকে দুর্ধর্ষ অপরাধীরাও ঢাকায় জড়ো হয়েছিল। কিন্তু গোয়েন্দাদের তৎপরতায় সেই জেল ভাঙার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তড়িঘড়ি করে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্র জানায়, কামালকে যেদিন ফাঁসি দেওয়া হয়, সেদিনই হঠাৎ জানানো হয়েছে পরিবারের সদস্যদের। কামালের সঙ্গে তার মা দেখা করতে যান কারাগারে। কামাল ছিলেন ফুরফুরে মেজাজে। কারণ তিনি জানেন, যে কোনো উপায়ে হোক, তাকে জেল ভেঙে ছিনিয়ে নেওয়া হবে। তাকে আটকানোর ক্ষমতা তখন আর কারও নেই। কামাল তার মাকে দেখে অবাক হন। কামালকে তার মা বলেন, সে দিনই তার শেষ দিন। তখন কামাল তার মাকে বলেন, এটা হতে পারে না। তাহলে তাকে জেলার জানাতেন। বিশ্বাস করতে না পেরে কামাল তার মাকে বলেন, জেলারের সঙ্গে দেখা করতে। যদি শেষ দিনই হয়, তাহলে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন তার মাকে। এই কথা শুনে কামালের মা জেলারের কাছে ছুটে যান। জেলার জানান, সে দিনই কামালের ফাঁসি হবে। তখন কামালের মা তার ছেলের কাছে ফের যেতে চাইলে তাকে আর সুযোগ দেওয়া হয়নি। কামালের সেই শেষ কথাটিও তার মায়ের কাছে জানানো হয়নি। না বলাই থেকে গেল মা আর ছেলের সেই শেষ কথাটি। সূত্র জানায়, জেল পালানোর পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ফাঁসি কার্যকরে কৌশল নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এক রকম গোপনেই তার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। ’৭৪ সালে কিছু করার মানসিকতা নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন কামাল। ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ওই সময়ে কামালের এক আত্মীয় তৎকালীন পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেই সুবাদে কামাল একটি গোয়েন্দা বিভাগের তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে চাকরি পান। এই কাজের জন্য কামালকে একটি মোটরসাইকেলও দেওয়া হয়। কিন্তু অপরাধ জীবনের হাতছানির কারণে ওই বছরই সেই চাকরি ছেড়ে দেন কামাল। কিন্তু মোটরসাইকেলটি তিনি ফেরত দেননি গোয়েন্দা সংস্থাকে। এই অভিযোগে পুলিশ কামালকে গ্রেফতার করে। কিছুদিন পর কামাল ছাড়া পান। ১৯৭৫ সালে কামাল বিয়ে করেন খালাতো বোন বিউটিকে। গেন্ডারিয়ায় বাসা ভাড়া করেন। কামাল তিন চারজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে গানের শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই বছর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কামালের পরিবর্তিত জীবন শুরু হয়। জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা হালিমের ছত্রছায়ায় অপরাধ জীবন শুরু করেন কামাল। মোহাম্মদপুরে তার খালাতো ভাই জামান খুন হন। ওই খুনের পর তিনি চলে যান পুরান ঢাকায়। ১৯৭৬ সালে ওয়াইজঘাট এলাকার জনৈক নুরু মিয়া সদরঘাট বার্ষিক ইজারা নিলেন কামালের সহযোগিতায়। এই ইজারা নেওয়াকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র দিলা-মোখলেসের সঙ্গে কামালের দ্বন্দ্ব বাধে। পরে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। দ্বন্দ্ব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, দেখামাত্র একে অপরকে গুলি করার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। গাল কাটা কামাল তাদের দুজনকে হত্যার নানা পরিকল্পনা করলেও শেষমেশ তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ক্ষুব্ধ কামাল পুরান ঢাকার ‘আজাদ’ সিনেমা হলের সামনে দিলা-মোখলেসের বাড়ির সামনে গিয়ে দুই রাউন্ড গুলি ছোড়ে। প্রতিদিন নিয়ম করে মোটরসাইকেলে করে আসতেন কামাল। কাউবয় স্টাইলে কোমরে গুঁজে রাখা দুটি পিস্তল দুহাতে নিয়ে দুম দুম করে গুলি করতেন তিনি। ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডন হিসাবে নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার ফিল্মি স্টাইলে নানা অপারেশনের কারণে। জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয়তাবাদী যুবদল গঠনের পর কামাল যুবদলে যোগদান করেন। তিনি কোতোয়ালি থানা যুবদলের সভাপতি মনোনীত হন। কামালকে রাজনৈতিকভাবে তখন ওপরে তোলেন বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন বিএনপির এক নেতা। এ পর্যায়ে কামাল তার পরিবার অর্থাৎ মা ও ভাই-বোনদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। অভয় দাস লেনে চিত্রনায়ক বুলবুল আহমেদের বোনের বাড়ি ভাড়া নেন কামাল। পল্টনে জাতীয়তাবাদী যুবদল কর্মী ছিলেন জাফর। তিনি ছিলেন অবাঙালি। নয়াপল্টনের জাফর নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে এই জাফরের নামডাক ছিল। তৎকালীন মন্ত্রী আবুল কাশেমের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এই জাফর। সেই সময়ে মতিঝিল ক্লাবপাড়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী জুয়াড়ি ছিলেন সিরাজ। সারা দেশের অপরাধীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় জুয়ার বোর্ড বসাতেন তিনি। এই সিরাজের সঙ্গে জাফরের কলহ হয় জুয়া নিয়ে। ক্লাবপাড়ায় শত শত লোকের সামনে সিরাজকে মাটি থেকে থুতু চাটতে বাধ্য করেছিলেন জাফর। এই অপমান সহ্য করতে পারেননি সিরাজ। জাফরকে হত্যার পরিবল্পনা আঁটেন তিনি। আর এ জন্য তিনি ভাড়া করেন রাজধানীর তখনকার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অপরাধী গাল কাটা কামালকে। কামাল ভাড়াটে খুনি হিসেবে জাফরকে হত্যা করেন। এর আগে জাফরকে অনুসরণ করতে করতে তিনি গুলিস্তান পর্যন্ত যান। কামান পয়েন্টে তিনি জাফরকে গুলি করেন। শত শত লোকের সামনে জাফরকে গুলি করে নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন কামাল। ঘটনাস্থলেই জাফরের মৃত্যু ঘটে। পরবর্তীতে ওই সিরাজের বিরুদ্ধে ক্লাবপাড়ায় খুনের অভিযোগ ওঠে। নাসির নামে এক যুবককে হত্যার পর লাশ লুকাতে আজাদ বয়েজ ক্লাবের ম্যানহোলে ফেলে রেখেছিল সিরাজ। সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার নওয়াবপুর এলাকার জাতীয়তাবাদী যুবদলের কর্মী ছিলেন ফিরোজ ও রানা। অভয় দাস লেনের প্রামাণিকের সঙ্গে ফিরোজ-রানার গোলমাল হয়। প্রামাণিক ছিলেন কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আপস-মীমাংসার কথা বলে যাত্রাবাড়ী থেকে ফিরোজ-রানাকে একটি জিপে তুলে নেন কামাল। তাদের নেওয়া হয় অভয় দাস লেনের শহীদ নবী বিদ্যালয়ের ভিতর। সেখানে ফিরোজ আর রানাকে কামাল জবাই করে হত্যা করে। হত্যার পর তাদের দেহ আর মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দুজনের খণ্ডিত লাশ আবারও জিপে তুলে নেন কামাল ও তার সহযোগীরা। জগন্নাথ কলেজের ভিতরের একটি মাঠে লাশ ফেলে রাখেন কামাল। এ ঘটনাটি তখন সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরবর্তীতে এই জোড়া খুনের ঘটনাই কামালের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। সূত্র জানায়, ১৯৮২ সালের প্রথম দিকে কামাল চিত্রজগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার বন্ধু ফজলুর রশিদ ঢালী ছিলেন ‘রসের বাঈদানী’ ছবির প্রযোজক আর কামাল ছিলেন এর প্লেব্যাক সিঙ্গার। রসের বাঈদানী ছবির প্রথম দিনের শুটিংয়ের খবর একটি পত্রিকায় গ্রুপ ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ওই ছবিতে কামালও ছিলেন। তখন পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল কামালকে। পত্রিকায় গ্রুপ ছবি দেখে পুলিশ কামালকে গ্রেফতারের সূত্র খুঁজে পায়। ঢালীর মোহাম্মদপুরের বাসায় হানা দেয় পুলিশ। তাকে জেরা করে পুলিশ। এক পর্যায়ে পরদিন যেখানে ঢালীর সঙ্গে দেখা হবে কামালের, সেখানে পুলিশ ওতপেতে থাকে। পরদিন কামাল এফডিসিতে যান। এফডিসি থেকে বেরিয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় যাওয়া মাত্র পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় ১১টি দেয়াল টপকান কামাল। কামালের তথ্য মতে পুলিশ ওই সময়ে তার বাসা থেকে দুটি রিভলবার উদ্ধার করে। সে সময় যুবমন্ত্রী আবুল কাশেম পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেন, কামালের সঙ্গে যুবদলের কোনো সম্পর্ক নেই। সামরিক আদালতে জাফর, ফিরোজ ও রানাসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলায় ফাঁসির রায় হয়। ১৯৮২ সালে সেই ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।

সর্বশেষ খবর