মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অস্ত্র মামলা তদন্ত ধামাচাপা

অবৈধভাবে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে পিস্তল রিভলবারসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র

সাখাওয়াত কাওসার

অস্ত্র মামলা তদন্ত ধামাচাপা

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর দিনাজপুর হিলি স্থলবন্দরসংলগ্ন ধরন্দা গ্রাম থেকে একটি পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন, সাত রাউন্ড গুলিসহ গোলাপ হোসেন (৪৫) নামের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি দল। রাত ১২টার দিকে গোলাপের খাটের তোশকের নিচ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র সম্পর্কে এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে তিনি নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করেছিলেন। ওই রাতেই এ ঘটনায় বিজিবির সুবেদার মো. আবদুল মান্নান বাদী হয়ে হাকিমপুর থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর ৩৭। তবে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (এল আই. বিজিবি) মো. গাওহারুল ইসলাম যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তা ছিল চমকপ্রদ। প্রতিবেদনে তিনি জানান, থানার রেকর্ডে গোলাপের বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ তথ্য পাওয়া যায়নি। তার স্বভাবচরিত্র ভালো। ঘটনাটি সাজানো, ষড়যন্ত্রমূলক। ঘটনার কিছু দিন পর মামলার বাদীও তা সাজানো বলে নিশ্চিত হয়েছিলেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়টি বাংলাহিলি এলাকায় অনেক মুখরোচক গল্পের উৎস হয়েছিল। সর্বশেষ তথ্য হলো, জামিনে থাকা অবস্থায় শেষ হাজিরার দিনে আদালতের যুগ্ম দায়রা জজ গোলাপের জামিন বাতিল করেছেন। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সব সাক্ষীকে তিনি তলব করেছেন। তদন্তে অবহেলার কারণে এ রকম অস্ত্র মামলা চাপা পড়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। আবার সীমান্ত এলাকায় চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা তাদের অনেককে হাত করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অস্ত্র ঢোকাচ্ছেন। ইদানীং বিভিন্ন এলাকায় গুলি করে খুনের ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে। গোয়েন্দারা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের সীমান্ত দিয়ে প্রচুর অস্ত্র ঢুকছে এমন তথ্য রয়েছে তাদের কাছে। বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়কে অবহিত করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাই তাদের সংগ্রহে রাখছেন এসব অস্ত্র।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার এজাহার ও তদন্তে গাফিলতির কারণে মাঝেমাঝেই অনেক আসামি আইনের ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন।

হিউম্যান রাইটস্ ফাউন্ডেশন প্রধান নির্বাহী  এ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, মামলার এজাহার এবং চার্জশীটের দুর্বলতা এবং গাফিলতির কারণে অনেক ক্রিমিনাল মামলার আসামী আইনের ফাঁক গলে বেড়িয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা আমাদের কাছে রয়েছে। অনেক সময় বড় বড় ঘটনায় ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার ঘটনাও দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিকল্পনা মাফিক আবার অনেকে অজ্ঞতার কারণেই তা ঘটিয়েছিলেন। পুলিশ সদর দফতর বলছে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৪৭টি অস্ত্র, ১৯ হাজার ৫৬টি গুলি, ৩ হাজার ৯৯২টি কার্তুজ উদ্ধার হয়েছে। ২ হাজার ৩টি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৭৪ জনকে।

আদালত সূত্র বলছে, ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন জজ আদালতে বিচারাধীন ৫ হাজার ৩৫৬টি অস্ত্র মামলা রয়েছে। রয়েছে ৫৫টি তদন্তাধীন মামলা। গত নভেম্বরে রাজধানীতে অস্ত্র মামলার সংখ্যা ১৫। এর ঠিক আগের মাসে ঢাকা মহানগরী পুলিশের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১২টি। গত বছর নভেম্বরে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা ছিল ১০।

গত ১৪ নভেম্বর রাত ৮টার দিকে বনানী ৪ নম্বর সড়কের এস মুন্সী ওভারসিজের মালিক সিদ্দিক মুন্সীকে তার নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার সমন্বয়কারী হিসেবে ৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে গুলশানের কালাচাঁদপুর থেকে হেলাল উদ্দীন নামের এক ব্যক্তিকে পাঁচটি পিস্তল, নয় রাউন্ড গুলিসহ গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগরী পুলিশ। ২ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে যশোর উপশহরের ‘সি’ ব্লকের বাড়ির সামনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘প্রত্যাশা সমাজকল্যাণ সংস্থা’র নির্বাহী পরিচালক গোলাম কুদ্দুস ভিকুকে (৫২) গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরের কদমতলী এলাকায় নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন পরিবহন ব্যবসায়ী ও যুবদল নেতা হারুনুর রশিদ চৌধুরী (৩৩)। তার চাচা চট্টগ্রাম নগর বিএনপির প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক দস্তগীর চৌধুরী।

৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরের এক সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ইউপিডিএফ ও সদ্যগঠিত ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করেছে। ৯ ডিসেম্বর মহেশখালী হোয়ানক কালাগাজির পাড়ায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে আবু কায়সার (১৮) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলেছে, প্রতিপক্ষ জালাল বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে আবু কায়সার মারা গেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক ঝগড়ায়ও এখন ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বেড়েছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার। আবার মাঝে মাঝেই ধরা পড়ছে ভুয়া লাইসেন্সের আগ্নেয়াস্ত্র্র। তবে দুই বছর ধরে পুলিশ, ডিবি ও র‍্যাব সদস্যরা মামলার তদন্ত, নিয়মিত টহল এবং জঙ্গি দমনে ব্যস্ত সময় পার করার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। প্রায় প্রতিদিনই খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। একসময় ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের পছন্দের তালিকায় একে-৪৭, এম-১৬ রাইফেল, সেকেন্দার বন্দুক থাকলেও এখন তারা ঝুঁকছে ক্ষুদ্র অস্ত্রের দিকে। পুলিশ, র‍্যাব ও ডিবির অভিযানে প্রায়ই আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি ধরা পড়লেও এর ব্যবহার যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপরাধ) রৌশন আরা বলেন, ‘অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশেষ অভিযান শিগগিরই শুরু হবে। এতে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রও জমা দিয়ে তা চেক করানোর কথা বলা হবে।’

একাধিক সূত্র বলেছে, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ভারত, ইতালি, চেকোশ্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, আর্মেনিয়া এসব উন্নত দেশে তৈরি অত্যাধুনিক ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র এখন অপরাধ জগতে ‘প্রিয়’। চাহিদা বেড়েছে তুরস্কের ‘টিসাস’ ব্র্যান্ডের পিস্তলের। প্রতি বছর নানা মাধ্যমে সীমান্তের চোরাই পথে অবৈধভাবে দেশে হাজার কোটি টাকার এ ধরনের ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রবেশ করছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে তৈরি পিস্তল ভারতের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে বলে তথ্য এসেছে। ভারতের সীমান্ত থেকে কেনা ভারতীয় ও পাকিস্তানি ২৫-৩০ হাজার টাকার ক্ষুদ্রাস্ত্র রাজধানীতে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। চাহিদা মেটাতে দেশের অন্তত ২৫টি সীমান্ত রুট দিয়ে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্রের চালান। তবে বেশি অস্ত্র ঢুকছে বেনাপোল, হিলি, ভোমরা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার সীমান্ত দিয়ে। সীমান্তে গরু আনার সময় অনেক রাখালের মাধ্যমে অস্ত্র এ দেশে ঢুকছে। পেশাদার সন্ত্রাসীরা অস্ত্র কিনে বিভিন্ন কাজে ভাড়া দিচ্ছে। আগামী নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর জন্য এসব অস্ত্রের কদর বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই। আবার পেশাদার ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজরা ওই অস্ত্র কিনছে। অনেকেই আধিপত্য বিস্তারে নিজের কাজে এসব ক্ষুদ্র অস্ত্র রাখছে।

১০ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার লছমানপুর থেকে তিনটি বিদেশি পিস্তল, ছয়টি ম্যাগজিন ও ১৪ রাউন্ড পিস্তলের গুলিসহ আবদুল করিম (২৪) নামের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব-৫। ২৬ আগস্ট রাজশাহীর চারঘাটের ইউসুফপুর থেকে চারটি পিস্তল, চারটি ম্যাগজিন, ১০ রাউন্ড গুলিসহ পাঞ্জাতন আলী (৩৮) নামের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব।

র‍্যাব-৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুব আলম বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় অনেকে অন্য পেশার আড়ালে অস্ত্র ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তবে মাঝে মাঝেই আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সফলতা পেয়েছি। সীমান্তে কিছুটা দুর্বোধ্য বিষয় হলো, একটি গরুর জন্য দুজন রাখাল থাকেন। প্রত্যেক রাখালকে আলাদা করে তল্লাশি করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে হয়তো সম্ভব হয় না।’

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ী রয়েছেন। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা সিন্ডিকেট রয়েছে শতাধিক। সীমান্ত পথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে এসব রুটে সহজেই বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে অস্ত্রের চালান। এ ছাড়া চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র তৈরি করা হয়। সীমান্তবর্তী এলাকা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি ও দিনাজপুরের হাকিমপুর থেকে সাত অস্ত্র ব্যবসায়ী অবৈধ অস্ত্রের বড় একটি অংশের জোগান দিচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাহিলির ইভান বাবু অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে সম্প্রতি জামিনে রয়েছেন। অন্যরা চেছড়া গ্রামের মামা-ভাগনে আনিস ও জুয়েল। হাকিমপুরের গোলাপ ও আলম একসময় পার্টনারশিপে ব্যবসা করলেও এখন আলাদা ব্যবসা করছেন। গোলাপের মেয়েজামাই দীপু বগুড়ায় অবস্থান করে এর মধ্যস্থতা করছেন। আরও রয়েছেন জাকির হোসেন ও রওশন। রওশন সম্প্রতি ছয়টি অস্ত্র নিয়ে ভারত থেকে আসার সময় বিএসএফের ধাওয়ায় সব কটি অস্ত্র ফেলে পালিয়ে এসেছেন।

র‍্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যেসব জায়গায় নির্বাচন হবে সেখানে পর্যাপ্ত টহলসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক সফলতাও আমরা পেয়েছি। অপরাধী সে যেই হোক, তাকে অপরাধী হিসেবে দেখে র‍্যাব।’

সর্বশেষ খবর