মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধির বহুল আলোচিত সেই গেজেটটি অবশেষে প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে গতকাল সন্ধ্যার পর আইন মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করে। আইন ও  বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এই বিধিমালা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা-২০১৭ নামে অভিহিত হবে। তবে এটি সার্ভিসের কোনো শিক্ষানবিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। বিধিমালায় বলা হয়েছে, দুর্নীতি, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কাজে জড়িত থাকা, শারীরিক বা মানসিক অদক্ষতার দায়ে সার্ভিসের কোনো সদস্যকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা, বাধ্যতামূলক অপসারণ বা অবসরে পাঠানো যাবে। গেজেটে সাতটি অধ্যায়ে সার্ভিসের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনুসন্ধান ও বিভাগীয় মামলা দায়ের, অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও অভিযুক্ত কর্মকর্তার পদমর্যাদা বিবেচনা, সাময়িক বরখাস্ত করা ও দণ্ড, তদন্ত ও দণ্ড আরোপ পদ্ধতি, গুরুদণ্ড, তদন্ত কার্যক্রম, শারীরিক বা মানসিক অদক্ষতার ক্ষেত্রে অনুসন্ধান, তদন্ত ও অন্যান্য করণীয়, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় পদ্ধতি, আপিল ও রিভিউ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সংজ্ঞায় অদক্ষতা বলতে সার্ভিসের কোনো সদস্য কর্তৃক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অদক্ষতা, অবহেলা অথবা দায়িত্ব পালনে শারীরিক বা মানসিকভাবে অদক্ষতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অসদাচরণ বলতে এই বিধিমালায় বর্ণিত কোনো বিধান  না মেনে চলা বা এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কাজ করা বা তাতে নির্দেমিত কাজ থেকে বিরত থাকা বা চাকরির শৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া সার্ভিসের কোনো সদস্য বা সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারক বা আদালতের কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে মিথ্যা, তুচ্ছ এবং বিরক্তিকর অভিযোগ পেশ করাও অসদাচরণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, সার্ভিসের সদস্যদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তথ্য পাওয়া গেলে বিভাগীয় মামলা করা যাবে। ফৌজদারি অপরাধ, দুর্নীতির অভিযোগেও মামলা করা যাবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে বেনামি চিঠিকেও গ্রহণ করা হবে। অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে সর্বশেষ জ্যেষ্ঠতা তালিকা অনুসারে অভিযুক্ত কর্মকর্তার তুলনায় জ্যেষ্ঠ হতে হবে। সার্ভিসের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে বিধি-৬ অনুসারে বিভাগীয় মামলা করার সময় বা পরবর্তী যে কোনো সময় উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুসারে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। আবার এক্ষেত্রে সাময়িক বরখাস্তের পরিবর্তে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতেও পাঠানো যাবে। সাময়িক বরখাস্ত থাকার সময় কোনো বিচারক বিচারিক বা কোনো দাফতরিক কাজে অংশ নিতে পারবেন না। বিভাগীয় মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী সদস্যকে তিরস্কার বা ভর্ত্সনা, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পদোন্নতি স্থগিত রাখা (অনূর্ধ্ব এক বছর) যাবে। দুর্নীতি, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কাজে জড়িত থাকা, শারীরিক বা মানসিক অদক্ষতার দায়ে সার্ভিসের কোনো সদস্যকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা, বাধ্যতামূলক অপসারণ বা অবসরে পাঠানো যাবে। সার্ভিসের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে দ্য পাবলিক সার্ভেন্টস ডিসমিসাল অন কনভিকশন অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫-এর শিডিউলে উল্লিখিত ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট আদালত উক্ত অপরাধ বিচারের জন্য অভিযোগ আমলে নিলে, উক্ত আদালত তা সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে জানাবে। উক্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা উচিত কিনা সে বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করবে। উক্ত কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলে ফৌজদারি মামলায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সাময়িক বরখাস্ত বহাল থাকবে। বিভাগীয় মামলায় তিরস্কার পেলে দোষী কর্মকর্তা দণ্ডপ্রাপ্তি ৩০ দিনের মধ্যে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করতে পারবেন।

এর আগে বিকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক অনুষ্ঠানে গেজেট প্রকাশের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধির  গেজেট প্রকাশ করতে বহুবার আদালতের কাছ থেকে সময় নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ রবিবার রাষ্ট্রপক্ষকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয় আপিল বিভাগ।

বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণবিধিমালা নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন চলছিল। বিশেষ করে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকার সময় আপিল বিভাগ বিভিন্ন সময় এ নিয়ে সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে। বিষয়টি নিরসনে এক সময় আপিল বিভাগ আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসারও আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে আইনমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করলেও সেই আলোচনা আর হয়নি। এরই মধ্যে প্রধান বিচারপতি সিনহা পদত্যাগ করলে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ১৬ নভেম্বর আইনমন্ত্রী জানান, শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে মতপার্থক্য দূর হয়েছে।   

এরপর গতকাল বিকালে আনিসুল হক বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে গেজেট প্রকাশের তথ্য জানান। আইনমন্ত্রী বলেন, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে একটা ঐকমত্যে পৌঁছে এই শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ করা হচ্ছে। বিচারপতি সিনহার প্রতি ইঙ্গিত করে আনিসুল হক আরও বলেন, এই শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে অনেক নাটক হয়েছিল। এক ব্যক্তি এটাকে রাজনীতিকরণ করার চেষ্টার কারণে এটা বিলম্বিত হয়েছিল। সেটা যখনই রিমুভড হয়ে গেছে, আমরা কিন্তু বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের ঐকমত্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে আজকে গেজেট করতে পেরেছি। আমি আজ আপনাদের বলব, বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না, নেই।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ) ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দেয়, তাতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা তৈরির নির্দেশনাও ছিল। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৭  মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী বলে এক শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ। পরে ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়কে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয়।

এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকারের সঙ্গে আদালতের মতপার্থক্যের কারণে ওই বিধিমালা  গেজেট প্রকাশের বিষয়টি ঝুলে থাকে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা শৃঙ্খলা বিধিমালার খসড়া গ্রহণ না করে ৩০ জুলাই কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহা। এ নিয়ে টানাপড়েনের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে প্রথমে ছুটি নিয়ে দেশ ছাড়েন, ছুটি শেষে ১০ নভেম্বর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বিচারপতি সিনহা।

সর্বশেষ খবর