বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১০২

শিশু অপহরণ খুনে পুলিশ

মির্জা মেহেদী তমাল

শিশু অপহরণ খুনে পুলিশ

বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছেন মতিন মিয়া। তার মোবাইলে একটি কল আসে। ‘হ্যালো। কে বলছেন! আমি মতিন। জি ভাই। হ্যাঁ ভাই আমি বাসাতেই। কে, আমার ছেলে! হ্যাঁ, সাঈদ স্কুলে গেছে। এই তো চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। কিন্তু ভাই, আপনি কে বলছেন? পরিচয় তো শুনলাম না।’ এভাবে কথা বলে যাচ্ছেন মতিন মিয়া। হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘ভাই কী বলতাছেন। আমার ছেলে আপনাদের কাছে, মানে? কী বলেন! ৫ লাখ টাকা! ভাই ভাই!’ ফোনের লাইন কেটে যায়।

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সাঈদের এমন অপহরণের খবর পেয়ে পাগলপ্রায় বাবা মাসহ পরিবারের লোকজন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নিয়েও সাঈদের খোঁজ মিলছে না। পুলিশও তন্ন তন্ন করে আনাচে কানাচে চষে বেড়াচ্ছে। সুখবর আসে না কোথা থেকেও। এটি সিলেট নগরীর দর্জিবন্দ এলাকার ঘটনা। রায়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ ২০১৫ সালের ১১ মার্চ স্কুল থেকে ফেরার পথে অপহৃত হয়। কিন্তু তাকে আর জীবিত পাওয়া যায়নি। অপহরণের তিন দিন পর ১৪ মার্চ নগরীর ঝরনারপাড় সোনাতলা এলাকায় একটি বাসার ছাদের চিলেকোটা থেকে তার বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অপহরণের পর সাঈদের বাবা ও মামার কাছে ফোনে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। এ ঘটনায় সেই রাতে কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি করেন অপহৃত সাঈদের মামা জয়নাল আবেদীন।

তদন্তে জানা যায়, অপহরণের পর মামা জয়নাল আবেদীন ও সাঈদের বাবাকে ফোন করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পাঁচ লাখ টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তারা দুই লাখ টাকা দাবি করে। প্রথমে টাকা নিয়ে শাহজালাল (রহ.) দরগায়  যেতে বলে অপহরণকারীরা। দরগায় যাওয়ার পর অপহরণকারীরা আবার ফোন করে সেখান থেকে এয়ারপোর্ট সড়কের বাইশটিলা এলাকায় যেতে। বাইশটিলায় যাওয়ার পর পুলিশ ও র?্যাবকে বিষয়টি  কেন জানানো হয়েছে অপহরণকারীরা ফোনেই তা জানতে চায়। এ সময় তারা সাঈদকে খুন করার হুমকি দিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়।

কোতোয়ালি থানা পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। তদন্তে যে মোবাইল ফোন থেকে সাঈদের বাবা ও মামার কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে সেই মোবাইল হ্যান্ডসেটটি ট্র্যাকিং করা হয়। ট্র্যাকিং করে দেখা যায়, বিমানবন্দর থানার কনস্টেবল এবাদুল এই ফোনটি ব্যবহার করছেন। এবাদুলকে কোতোয়ালি থানায় ডেকে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে প্রথমে কনস্টেবল এবাদুল শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে। একপর্যায়ে সে বিষয়টি স্বীকার করে এবং শিশু সাঈদকে খুন করা হয়েছে বলে জানায়। এবাদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঝেরঝেরি পাড়ার সবুজ ৩৭ নম্বর বাসার চিলেকোটা থেকে শিশু সাঈদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একটি পাটের ও ৬টি প্লাস্টিকের বস্তায় মোড়ানো ছিল লাশ। শিশুটির গলায় প্রায় দুই হাত লম্বা একটি রশি লাগানো ও গলায় রশির দাগ মিলেছে। শিশুটির গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এবাদুলের দেওয়া তথ্যমতে নগরীর বন্দরবাজার থেকে পুলিশ জেলা ওলামা লীগ সাধারণ সম্পাদক রাকিব ও  কোর্ট পয়েন্ট সংলগ্ন মধুবন মার্কেটের সামনে থেকে পুলিশের সোর্স গেদাকে আটক করে। তদন্তে জানা যায়, এবাদুল, রাকিব ও গেদা-এ তিনজন মিলেই শিশুটিকে অপরহরণ করে হত্যা করে। অপহরণের পরদিন সকালের দিকে শিশু সাঈদকে হত্যা করা হয়। শিশুটির বাবার সঙ্গে আটক কনস্টেবলের পূর্ব পরিচয় ছিল।

বিচার : হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৬ মাস পর ২০১৫ সালের ২৩  সেপ্টেম্বর সিলেট মহানগর হাকিম ১ম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) আবদুল আহাদ চৌধুরী। মামলাটি তদন্ত করেন কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোশাররফ হোসাইন। ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২৯ অক্টোবর সাঈদ অপহরণ ও হত্যা মামলা সিলেট মহানগর হাকিম প্রথম আদালত থেকে সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ওইদিন আলোচিত এই হত্যা মামলায় ৮ নভেম্বর চার্জ গঠনের তারিখ নির্ধারণ করে আদালত। কিন্তু ৮ নভেম্বর চার্জ গঠিত হয়নি। তবে ওইদিন পলাতক থাকা মাহিব  হোসেন মাসুমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দেয় আদালত। পরে ১০ নভেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করে মাসুম জামিন আবেদন জানালেও আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়।

গত ১৯ নভেম্বর থেকে আলোচিত সাঈদ হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। টানা ৬ কার্যদিবসে সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্য দিয়ে গত ২৬ নভেম্বর শেষ হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কাজ।

সিলেটে শিশু আবু সাঈদ হত্যা মামলায় পুলিশ কনস্টেবল ও ওলামা লীগ নেতাসহ ৩ জনকে ‘ডাবল মৃত্যুদণ্ড’ দিয়েছে আদালত। ২০১৫ সালের পয়লা ডিসেম্বর সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুর রশিদ এ মামলার রায়  ঘোষণা করেন। রায়ে একজনকে খালাস দেয় আদালত।

আসামিদের প্রথমে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির জন্য দণ্ডবিধির ৭ ও ৮ ধারায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। একইসঙ্গে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। অন্যদিকে সাঈদকে অপহরণ করে হত্যার জন্য দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায়ও তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে আদালত। একইসঙ্গে আরও এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।

দণ্ডপ্রাপ্তরা হলো, সিলেটের বিমানবন্দর থানার সাবেক কনস্টেবল এবাদুর রহমান পুতুল, জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাকিব, পুলিশের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদা। এ ছাড়া ওই মামলার আরেক আসামি ওলামা লীগ নেতা মাহিব হোসেন মাসুমকে খালাস প্রদান করা হয়। বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে ওই হত্যা মামলার চার আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাদের উপস্থিতিতে রায় পড়ে শোনান আদালতের বিচারক আবদুর রশিদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর