শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিমানবাহিনীর সফল এক আক্রমণে পরাস্ত হতে থাকে পাকসেনা

শামসুল আলম, বীরউত্তম

বিমানবাহিনীর সফল এক আক্রমণে পরাস্ত হতে থাকে পাকসেনা

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পাক হানাদার বাহিনীর জ্বালানি তেলের ডিপোতে হামলার পর থেকে তারা একের পর এক পরাস্ত হতে থাকে। আর এ কাজটি করেছিলেন বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ওই হামলার পর থেকে বিজয়ের আগ পর্যন্ত অন্তত ৪০টি আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছিল। এর আগে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বিমানবাহিনীর লোকদের দিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিমানবাহিনীর ইউনিট গঠন করা হয়। এতে তিনজন কর্মকর্তাসহ মোট ৫৭ জন বিমানসেনা ছিলেন। আমি ছাড়া অপর দুই কর্মকর্তা হলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম। আমরা তখন সিলেট সীমান্তঘেঁষা ভারতের কৈলাসপুরে অবস্থান করি। নাগাল্যান্ডে অবস্থিত ভারতীয় বিমানবাহিনীর ডিমাপুর বেসে চলত আমাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ। আর পাশের জোড়হাট বেসের কমান্ডার ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধে আমরা পুরনো কিছু রকেট আর একটি এয়ারক্রাফট সংগ্রহ করি। এয়ারক্রাফটি মূলত যাত্রী আনা-নেওয়ার জন্য ছিল। সেটি যুদ্ধের উপযোগী করে গড়া হয়। টানা প্রশিক্ষণের একপর্যায়ে ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তেল শোধনাগারে হামলার সিদ্ধান্ত হয়। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল। তখন বিকাল ৪টা। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা এসে বললেন, মিশন বাতিল করতে হবে। শুনে আমরা অবাক হলাম। বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন বেশি কিছু জানতে চেয়ো না। পরবর্তী মিশনের দিন জানানো হবে।’ আমরা সবাই অপেক্ষায় থাকলাম। যে কোনো মূল্যে আমাদের মিশন সফল করতেই হবে। কারণ ওই তেল শোধনাগার থেকে সব অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের বিমান, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান ও যুদ্ধে ব্যবহৃত গাড়ির তেল সরবরাহ করা হতো। তা ধ্বংস করতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধের সব রসদ ফুরিয়ে যাবে। এসব চিন্তা তখন আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এরপর ৩ ডিসেম্বর রাত ১২টা ০১ মিনিটে হামলার পরিকল্পনা করা হলো। এর আগে বিকাল ৪টার দিকে ভারতের বিমানবাহিনীর বিভিন্ন বেসে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তখন পশ্চিমবঙ্গের একটি জনসভায় ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তানের হামলার ঘটনায় তাত্ক্ষণিকভাবে তিনি দিল্লি চলে যান এবং সন্ধ্যায় মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার। আগে থেকেই রেডিওতে প্রচার করা হয় যে ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ১২টার দিকে যখন তিনি রেডিওর মাইকে ভাষণ দেবেন, তখন তাকে একটু অপেক্ষা করার অনুরোধ করেন ভারতের তৎকালীন এয়ার চিফ পি সি লাল। ইন্দিরা গান্ধী কারণ জানতে চাইলে তিনি আমাদের হামলার পরিকল্পনার কথাটি জানান। তখনই ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধ ঘোষণা দিলে সব পাকিস্তানি সেনা সতর্ক হবে, আর আমাদের মিশন ব্যর্থ হবে এমন আশঙ্কা কাজ করছিল পি সি লালের মনে। ১২টার বদলে ১২টা ১০ মিনিটে রেডিওতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইন্দিরা গান্ধী। এর আগে আমরা পরিকল্পনার চার মিনিট দেরিতে ১২টা ০৫ মিনিটে চট্টগ্রামের তেল শোধনাগারের খুব কাছে গিয়ে প্রথম ধাপে দুটি রকেট হামলা চালাই। আক্রমণে আমি ছাড়া ক্যাপ্টেন আকরাম, করপোরাল রুস্তম ও নুরুল হক অংশ নেন। প্রথমে নিশানা অনুযায়ী রকেট আঘাত হানলেও তেলের ট্যাঙ্কারগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বিতীয় ধাপে আরও রকেট আঘাত করলেও একই ফল দেখা যায়। এসব হামলার জন্য আমরা দিক পরিবর্তন করছিলাম। যখন তৃতীয় হামলার প্রস্তুতি নিই, তখন পাকিস্তানি বাহিনী সতর্ক হয়ে অ্যান্টি এয়ারক্রাফট ফায়ার করতে থাকে। গুলি আমাদের আশপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আর আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের কিছুই হয়নি। তৃতীয় ধাপের রকেট হামলায় তেলের ট্যাঙ্কার বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হয়। এভাবে ছয়বারে ১২টি রকেট হামলা চালিয়ে আমরা বঙ্গোপসাগরের মধ্যে এসে দেখি জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছে তেল শোধনাগার। ভোর ৪টার দিকে আমরা কোম্বিগ্রামে ভারতের বিমানবাহিনীর প্রপার বেসে ল্যান্ড করি। তখন চন্দন সিং আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘বয়, ইউ হ্যাভ ডান ইট।’ তিনি আমাদের সফল হামলার কথা বিবিসির মাধ্যমে জানতে পারেন। ওই হামলার মধ্য দিয়ে মূলত পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়। তখন থেকে আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। তেজগাঁও বিমানবন্দরে ৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর তিন দিন তাদের বিমান ফ্লাই করতে পেরেছিল। এরপর আর পারেনি। আর আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন বেসে ৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর প্রপাগান্ডার লিফলেট বিতরণ করলাম। সেখানে লিখা ছিল, তোমাদের সৈন্যরা নানা স্থানে হার স্বীকার করেছে, তোমরাও আত্মসমর্পণ কর। ১৩ আর ১৪ ডিসেম্বর আমরা প্রহর গুনছি কখন বিজয়ের সংবাদ পাব। ১৫ ডিসেম্বর জানতে পারি, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে জানতে পারলাম নিয়াজি আত্মসমর্পণ করে স্বাক্ষর করেছেন। তখন আমাদের মধ্যে ব্যাপক উল্লাস সৃষ্টি হয়। আমরা সবাই সে সময় বিজয়ের আনন্দে কেঁদেছিলাম। আর চন্দন সিং ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা পাইলটের স্বাক্ষরযুক্ত আমাদের জাতীয় পতাকা স্মৃতিস্বরূপ রেখে দিয়েছিলেন।

যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হিসেবে রাওয়ালপিন্ডিতে কর্মরত ছিলাম। স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৩ জুন আমি পালিয়ে আসি। ঢাকায় এসে আগরতলা গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। সে সময় পাকিস্তানে অবস্থানরত মাত্র ১৭ জন কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। অনুলিখন : মাহবুব মমতাজী

সর্বশেষ খবর