শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিরনিদ্রায় শায়িত মহিউদ্দিন চৌধুরী

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম

চিরনিদ্রায় শায়িত মহিউদ্দিন চৌধুরী

লালদীঘি ময়দানে গতকাল চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জানাজায় মানুষের ঢল নামে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

গুণমুগ্ধ লাখ লাখ মানুষকে শোকসাগরে ভাসিয়ে গতকাল ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ‘চট্টগ্রামের অভিভাবক’ খ্যাত সাড়াজাগানো প্রাজ্ঞ রাজনীতিক এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে গেছেন। বিকালে লালদীঘি ময়দানে তার নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল নামে। এখান থেকে লাশ নেওয়া হয় চশমাহিলের বাড়িতে। সেখানেও মাগরিবের পর আরেকবার নামাজে জানাজা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চট্টলবীরকে শেষ বিদায় জানাতে এসে আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন মহিউদ্দিন ভাইকে। এ ছাড়া দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন মহিউদ্দিন ভাই। তিনি চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে চাননি। মহিউদ্দিন চট্টগ্রামের, চট্টগ্রাম মহিউদ্দিনের।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতামুক্ত হবে। চট্টগ্রাম হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখতে আমরা কাজ করে যাব।’

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দেশ ও জনগণের প্রতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশ ও মানুষের কল্যাণে তার অবদানের কথা জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, মহিউদ্দিন সব আন্দোলনে অগ্রণী ছিলেন। তিনি বার বার কারাযন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে কোনো দিন আপস করেননি। সরকারপ্রধান বলেন, জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরীর অবদান চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘গণমানুষের হূদয়ে তিনি চিরজীবী হয়ে থাকবেন’। প্রধানমন্ত্রী তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা জানান।

লাখো মানুষের ঢল : লালদীঘি ময়দানে জানাজায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নেয়। এর আগে নগর আওয়ামী লীগ অফিসে নেওয়া হয় লাশ। জানাজায় ইমামতি করেন মাওলানা আনিসুজ্জামান। জানাজায় শরিক হন ওবায়দুল কাদের, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বরিশাল-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সংসদ সদস্য ডা. আফসারুল আমীন, ফজলে করিম, দিদারুল আলম, নজিবুল হক মাইজভাণ্ডারী, যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, বিএনপি নেতা গোলাম আকবর খোন্দকার, সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, সাবেক এমপি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম এ ছালাম প্রমুখ।

বর্ণাঢ্য জীবন : সাহসী এই রাজনীতিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনে, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর প্রতিরোধযুদ্ধ আয়োজনে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, এমনকি হাল আমলেও চট্টগ্রাম নগরের উন্নয়ন প্রশ্নে তেজস্বী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তাই সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘চট্টলবীর’। এই বীরকে হারিয়ে এখন শোককাতর হয়ে আছে জনগণ। দলমতনির্বিশেষে অভিভাবক হারানোর মাতম চলছে চট্টগ্রামে। তিন মেয়াদে ১৬ বছর চট্টগ্রামের মেয়র ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। কি নগরীর, কি গোটা দেশের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে শামিল হওয়ার জন্য তিনি ডাক দিলেই ছুটে আসত আমজনতা। সেজন্যই সুধীসজ্জনের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’। সেই বাঁশিওয়ালার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ভিড় করেছে তারা দলে দলে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য মেহেদীবাগের ম্যাক্স হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী। হাসপাতালে আনার পর তার কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়। তার বড় ছেলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছানোর পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হয়। ব্যারিস্টার নওফেল বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষের প্রিয়জন ছিলেন আমার বাবা। ঢাকায় একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রাম আসতে চেয়েছিলেন। তাই তাকে এখানে আনা হয়েছিল।’ নওফেল বলেন, ‘একপর্যায়ে কোনো সাড়া না পাওয়ায় সবার সঙ্গে আলোচনা করে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়েছে।’ নেতা-কর্মী ও অনুরাগীরা আগে থেকে হাসপাতালে ভিড় করছিলেন। নেতাপুত্রের মুখ থেকে নেতার মৃত্যুর ঘোষণা শুনে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

পাগল সেজে মুক্ত হওয়া : ষাটের ছাত্র রাজনীতিতে সামরিক পাক শোষকের বৈষম্যরীতির বিরুদ্ধে ৬ দফা, ১১ দফা ও ১ দফার আন্দোলনের মাঠের কর্মী বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য মহিউদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গঠন করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। এজন্য পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেফতার হন। নৌঘাঁটিতে নিয়ে তার ওপরে নির্যাতন চালানো হয়। কারাগারে নেওয়া হলে তিনি পাগলের অভিনয় করেন। তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে তিনি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর যুক্ত হন ‘মাউন্টেন ডিভিশন’-এ। বিএলএফ কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে সক্রিয় মহিউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রাম শহরের রাজনীতিতে ‘ডিসাইডিং ফ্যাক্টর’ হয়ে ওঠেন। কালক্রমে ছাত্রনেতা, শ্রমিকনেতা থেকে পরিণত হন জাতীয় নেতায়।

মাটির মানুষের মাটির নেতা : ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথমে দেশে ও পরে ভারতে পলাতক অবস্থায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্রিয় হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ভারতে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ সহজতর না হলে কঠিন মানবেতর জীবনে পড়েন তিনি। কারখানার শ্রমিক, টংয়ের চা বিক্রেতাও হতে হয় তাকে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রধানতম নেতা হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। পরবর্তীতে ‘বন্দরটিলা ট্র্যাজেডি’তে ক্ষতবিক্ষত মানুষের লাশ নিজের হাতে ধুয়ে ও দাফন করে সাড়া তোলেন। তখন তাকে বলা হয় ‘মাটির মানুষের মাটির নেতা’।

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা : চট্টগ্রামের উন্নয়নের এই স্বপ্নবান পুরুষ চসিককে আত্মনির্ভর ও প্রকৃত সেবামূলক করতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সিএনজি পাম্প থেকে শুরু করে ওষুধ তৈরি ও পানি প্রক্রিয়াতকরণ, বৈদ্যুতিক জ্বালানি উৎপাদন, শপিং কমপ্লেক্স, আবাসন প্রতিষ্ঠাসহ বহুমাত্রিক উদ্যোগ নেন। রিকশাচালকদের লাইসেন্স ফি মওকুফ ও নগরবাসীর হোল্ডিং ট্যাক্স বর্ধিত না করেও ব্যাপক প্রশংসা পান সর্বশেষ হারিকেন প্রতীকে বিপুল বিজয়ী মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী।

গ্র্যান্ড হোটেল আর বিজয়মেলা : রাজনীতির প্রাথমিক পাঠে সিটি কলেজ ও গ্র্যান্ড হোটেলকেন্দ্রিক নিজস্ব বলয় তৈরি করেন তিনি। ছাত্র-যুব নেতা-কর্মীদের প্রভাবিত করার অবর্ণনীয় ব্যক্তিমাধুর্য ছিল তার। ১৩ ছাত্রনেতাকে আত্মসমর্পণ করিয়ে জনমানুষকে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। মানুষের হূদয়ের গহিনে তিনি এতটাই ঠাঁই করে নিয়েছিলেন যে, কারারুদ্ধ হলে তার মুক্তির দাবিতে ‘ওয়ান ইলেভেনে’র দুর্মর সময়েও জরুরি আইন ভেঙে ভক্তরা মিছিল করে কারাবরণ করেছিলেন। এদিকে, চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা আয়োজন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নবপ্রজন্মে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে অনন্য ভূমিকা রাখেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার নেতৃত্বে প্রায় তিন দশক ছুঁতে চলা এই মেলা আজ চাটগাঁর গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র ‘মুক্তিযুদ্ধ চট্টগ্রাম’ও নির্মাণ করেন এই বীর যোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের বইমেলারও প্রবক্তা তিনি।

গহিরা থেকে শুরু : রাউজানের গহিরা গ্রামের বকসআলী চৌধুরী বাড়িতে ১৯৪৪ সালে ১ ডিসেম্বর মহিউদ্দিনের জন্ম। বাবা হোসেন উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন রেলওয়ে কর্মকর্তা। মায়ের নাম বেদুরা বেগম। ডিগ্রি অর্জনের পর স্নাতকোত্তর শিক্ষা গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনীতিকবলিত জীবন তাকে লেখাপড়ায় আর অগ্রসর হতে দেয়নি। মহিউদ্দিন চৌধুরীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে ব্যারিস্টার নওফেল, ছোট ছেলে বোরহানুল হাসান চৌধুরী সালেহীন ব্যবসায়ী, মেয়েদের মধ্যে জেবুন্নেসা চৌধুরী লিজা গৃহিণী। যমজ নুসরাত শারমিন পিয়া ও ইশরাত শারমিন পাপিয়া মালয়েশিয়ায় এমবিএ পড়ছেন। তার এক মেয়ে ২০০৮ সালের ১৭ অক্টোবর ক্যান্সারে মারা যান, তার নাম ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা।

সর্বশেষ খবর