রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সরকারি হাসপাতালে বেহাল চিকিৎসা

সাঈদুর রহমান রিমন

সরকারি হাসপাতালে বেহাল চিকিৎসা

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পরপরই সারা দেহে রামদার অসংখ্য কোপে রক্তাক্ত আবদুল আজিজকে (২৭) খিলগাঁও থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান স্বজনরা। অবিরাম রক্তক্ষরণে ক্রমেই নিস্তেজ হতে থাকে রোগী। আবেদন-নিবেদন, চিল্লাফাল্লা করে একটি ট্রলি পর্যন্ত জোগাড় হয়নি। নিজেরাই ধরাধরি করে জরুরি বিভাগের মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে এবার ডাক্তার খোঁজার পালা। ডিউটি রুম, রিসিপশন, জরুরি বিভাগের কক্ষ—কোথাও কর্মরত ডাক্তারকে পাওয়া যাচ্ছিল না। ওয়ার্ডবয় বলছিলেন, ‘টাকা দেন, চিকিৎসার জন্য আমিই যথেষ্ট।’ ততক্ষণে আবদুল আজিজের ছটফটানিতে স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। কিন্তু ওয়ার্ডবয় অনড়। ডাক্তার নিরুদ্দেশ। স্বজনদের কেউ কেউ তার রক্তক্ষরণের স্থানগুলো হাতের তালুতে চেপে ধরে রক্ত বন্ধের বৃথা চেষ্টা চালাতে থাকেন। কেউবা হাত-পায়ের তালু ম্যাসাজের মাধ্যমে গরম রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এভাবেই মুমূর্ষু আজিজকে নিয়ে টানা তিন ঘণ্টা ধরে নানা কসরত চলে স্বজনদের। এ সময় হাসপাতাল কর্মীরা ছিলেন কেবলই নীরব দর্শক। রাত ৯টা ৪১ মিনিটে কর্মরত ডাক্তার তার কক্ষে ঢুকে, ফ্রেশ হয়ে তারপর ছুটে যান জরুরি বিভাগে। একনজর দেখেই বলে ওঠেন, ‘সর্বনাশ, রোগীর অবস্থা খুবই শোচনীয়! এখনই তাকে অপারেশন  থিয়েটারে নিয়ে যাও।’ জরুরি ভিত্তিতে তার রক্তক্ষরণ বন্ধ করে সারা দেহে ব্যান্ডেজ বেঁধে ওয়ার্ডে পাঠানোর পর শুরু হয় ধারাবাহিক অবহেলা। সেখানে ডাক্তার-নার্স দূরের কথা, আয়া বা ওয়ার্ডবয়কে পেতেও বেগ পেতে হয়। এ অবস্থায় আজিজ বলেন, ‘শুধু প্রাণ বাঁচাতেই ঢাকা মেডিকেল ছেড়ে অন্যত্র চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছি।’ সোমবার ভোরবেলা থেকেই আউটডোরের সামনে রোগীদের লম্বা লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগী নিয়ে অনন্ত অপেক্ষা। ওপিডি পেশেন্ট কার্ড বা ১০ টাকার টিকিট কেটে ডাক্তার দেখানোর লাইন। রাস্তা, বারান্দা, হাসপাতাল প্যাসেজে শুয়ে কাতরাচ্ছেন মুমূর্ষু রোগী। আর একটু তাড়াতাড়ি ডাক্তার দেখাতে মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্বিগ্ন পরিজন। প্রতিদিন এই একই ছবি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের। ডাক্তার দেখানোর জন্য সকাল থেকে লাইন ধরে অপেক্ষায় থাকা মানিকগঞ্জের মরিয়ম আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ায় ছটফট করছিলেন তিনি। কিন্তু টয়লেটেও যেতে পারছেন না। আউটডোরে বাথরুমের অবস্থা এত খারাপ যে সেখানে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দুপুর পেরোনোর পর মরিয়ম বেগমকে হাসপাতালের মেঝেতে শোয়া অবস্থায় দেখা গেল। রোগীর স্বামী অনেক কষ্ট করে দুই হাজার টাকা ধারদেনা করে মরিয়মকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। সোহরাওয়ার্দীতে আসার পরপরই কবির নামের এক দালাল পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে বলেছেন, এ টাকা পেলে তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে রোগী ভর্তি করিয়ে দেবেন; সরকারি ওষুধপথ্যের ব্যবস্থাও তিনিই করিয়ে দেবেন। কিন্তু সে দাবি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় মরিয়মকে ভর্তি করানো যাচ্ছে না। মরিয়মের স্বামী আনসার আলী বলেন, ‘ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করেছি ভর্তি করার জন্য। তাদের হাতে-পায়ে ধরেও ভর্তি করা যায়নি। কারণ দালালদের কথাই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে শেষ কথা। দালালদের উৎপাত ও টাকা লেনদেনের দৃশ্য সেখানে ওপেন সিক্রেট। দালালদের খপ্পরে পড়ে মুহূর্তেই রোগী ‘চালান’ হয়ে যায় আশপাশের প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে। বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই।

বেহাল দশা কাটছেই না : দেশের স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা কাটছেই না। হাসপাতাল আছে, যন্ত্রপাতি ওষুধপথ্যের সরবরাহ যাচ্ছে নিয়মিত, আছে চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী; শুধু নেই কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা। রাজধানী থেকে শুরু করে নিভৃত পল্লী পর্যন্ত সর্বত্রই অভিন্ন অবস্থা। চিকিৎসকের বদলে নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়ারা রোগী দেখা, ব্যবস্থাপত্র দেওয়া থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করছেন অবলীলায়। এতে মাঝেমধ্যেই রোগীর পেটের ভিতর গজ-ব্যান্ডেজ, ছুরি-চাকু রেখে সেলাই করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। ওয়ার্ডবয়-আয়ার ‘ডাক্তার সাজা’র মধ্যেই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা সীমাবদ্ধ থাকছে না, আছে বহিরাগত দালালদের অন্তহীন উৎপাত। দালালরা নানা কায়দা-কৌশলে অসহায় রোগীদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। এসব দেখভালের যেন কেউ নেই। খোদ রাজধানীতেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বড় বড় হাসপাতাল আছে, চিকিৎসা সরঞ্জামেরও অভাব নেই, শুধু সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় সেবাবঞ্চিত থাকছেন রোগীরা। ডাক্তারের অবর্তমানে ওয়ার্ডবয় আর নার্সদের গাফিলতিতে আয়ারা হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। আছে দালালদের সীমাহীন উৎপাত। হাসপাতালে ভর্তি করতে দালাল, ওয়ার্ডে বেড পাওয়া নিশ্চিত করতে দালাল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও দালালদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। পঙ্গু ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীর জন্য ট্রলি ব্যবহার করতেও গুনতে হয় টাকা। রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকা ট্রলি নিয়ন্ত্রণে রেখে মিটফোর্ড হাসপাতালেও বাড়তি টাকা কামায় বহিরাগতরা। ছুটির দিন আর রাতের বেলায় হাসপাতালগুলোর চেহারা যেন আমূল পাল্টে যায়। বহু খোঁজাখুঁজি করেও কর্মরত ডাক্তারদের সন্ধান মেলে না। দরজা আটকে বিশ্রামে থাকা নার্সদের ডাকলে রীতিমতো রক্তচক্ষু দেখতে হয়। অন্যদিকে কানে মোবাইল ফোন লাগিয়ে খোশগল্প করার ফাঁকে ফাঁকে রোগী দেখা ডাক্তারদের দুর্ব্যবহারের শেষ নেই। অতিসম্প্রতি এক নারী-ডাক্তারকে আপা বলার কারণে রোগী ও তার স্বজনদের লাঠিপেটা পর্যন্ত খেতে হয়েছে। কোনো রোগীর খারাপ পরিস্থিতি জানাতে গেলেও তেড়ে আসেন ডাক্তার। জের হিসেবে রোগীকে অযথা যন্ত্রণা দেওয়ার শাস্তি প্রদানের মতো গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গেছে। শাস্তির ধরন হিসেবে ভুক্তভোগী এক রোগী জানান, একটা ইনজেকশন পুশ করার নামে তার ডান হাতের ১৮টি স্থানে ফুটো করা হয়েছে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে।

ভিড়-ভাড়াক্কা আর দালাল উৎপাত : দেশের প্রধান হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সর্বত্রই শুধু ভিড়-ভাড়াক্কা আর লাইনের ছড়াছড়ি। সকালে আউটডোরে ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব বিভাগে, এমনকি ভর্তি হওয়া রোগীদের টয়লেটের জন্যও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। এক্স-রেসহ জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কিডনি ডায়ালাইসিস, অপারেশনের জন্যও সিরিয়াল ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয় রোগীদের। ফলে রোগীর অবস্থা যতই সংকটাপন্ন হোক, অপারেশন যতই জরুরি হোক, লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো সেবাই সেখানে পাওয়ার পথ নেই।

এমনিতে রোগীর তুলনায় চিকিৎসক কম, তার ওপর সময়মতো ডাক্তার না আসায় রোগীদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়। ৪০ বছর আগের জনবল কাঠামো দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন হাসপাতালের কর্মীরা। রাতে দালালের দখলে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তখন অবস্থা দাঁড়ায় ‘আগে টাকা তার পরে চিকিৎসা’। এ নিয়েই রোগীর স্বজনদের সঙ্গে চলে দরকষাকষি। বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয় এমন ধারণা নিয়েই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানীর প্রধান হাসপাতালটিতে আসেন গরিব রোগীরা। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। হাসপাতালের গেট থেকে ওয়ার্ডের বেড পর্যন্ত যেতে দফায় দফায় টাকা দিয়ে তবেই মেলে কিঞ্চিৎ চিকিৎসাসেবা। ঘুষখোর ও দালালচক্র আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে রাখে রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের। চিকিৎসাসেবা সবই হাতের নাগালে। জরুরি বিভাগ চালু ২৪ ঘণ্টা। তবে টাকা ছাড়া সেবার কথা কল্পনাও করা যায় না। হাসপাতালের লোকবল কম থাকার অজুহাতে নার্স ও আয়াদের সঙ্গে কাজ করেন দালালরা। সবই ঘটছে হাসপাতালে ডিউটিরত চিকিৎসা সহকারীর যোগসাজশে। আর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রবেশমুখে রয়েছে দালালদের বিশাল সিন্ডিকেট। তারা কোনো রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে ভিড় জমিয়ে লুফে নিচ্ছে রোগীদের।

হাসপাতালের অন্দরমহল বিশ্রী-কদাকার : রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর অন্দরমহল খুবই বিশ্রী, বড়ই কদাকার। হাসপাতালজুড়ে নোংরা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, ওষুধের খোসা, স্যালাইনের খোসা পড়ে থাকে যত্রতত্র। ভাঙা দরজা, টয়লেট প্যানের অপরিচ্ছন্নতায় সীমাহীন দুর্গন্ধে রোগীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও অচল থাকায় তরল ময়লা নর্দমায় মিলেমিশে হাসপাতাল আঙিনাও সয়লাব থাকে। প্রতিটি হাসপাতালেরই রান্নাঘরের অবস্থা শোচনীয়। বাসি, পচা, গলা নানা খাদ্যপণ্যের উৎকট গন্ধে রান্নাঘরে টেকা মুশকিল। সেখানে বিড়াল চাটে খাবারের ট্রে; ইঁদুর ছোটে ওয়ার্ডে। তেলাপোকা, টিকটিকি থেকে শুরু করে মশা-মাছি, ছারপোকার উপদ্রব সবই চলে রাত-দিন।

হাসপাতালের অন্দরমহল যে কতটা নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, পূতিগন্ধময় তা মুগদার বহুতল জেনারেল হাসপাতালের রন্ধনশালায় ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যায়। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে নোংরা বাসন-পেয়ালা, ট্রে। হাঁড়ি-পাতিল ধোয়ামোছার নামে ফেলে রাখা হয় খোলা ড্রেনের পাশে। রান্নাঘরের নোংরা মেঝেতেই পড়ে থাকে তরিতরকারির কাটাকুটি, বাসি-পচা খাদ্যপণ্য। ছাদের অংশে লেগে আছে কালিঝুলি। বাতাসে সেসব ময়লা ঝুলি উড়ে এসে পড়ছে রান্নার হাঁড়ি-পাতিলে। বড় কড়াইয়ের চারপাশে লেগে থাকে আগের ডাল-তরকারির ঝোল। এর মধ্যেই নতুনভাবে তরকারি রান্না চলে। ভাত যে ঝুড়িতে রেখে মার ফেলা হয় সেটি কখনই ধোয়া হয় না। যেসব ট্রেতে খাবার দেওয়া হয় সেগুলো ধোয়ার নামে শুধু ড্রামভর্তি পানিতে চুবিয়ে নেওয়া হয়। সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের ট্রে আলাদা রাখারও ব্যবস্থা নেই। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা মুগদা জেনারেল হাসপাতাল নয়, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ফুলবাড়িয়া সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, কিডনি ও মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল, মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও বক্ষব্যাধি হাসপাতালে অভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পচা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের রোগীরা। বেশির ভাগ ওয়ার্ডের আশপাশে নানা ধরনের বর্জ্য প্রতিনিয়তই ফেলে রাখা হচ্ছে। ক্লিনার-সুইপাররা কাজ না করে আড্ডা আর গল্প করে সময় পার করে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। হাসপাতাল প্রশাসনের উদাসীনতায় এখানকার পরিবেশ দিন দিন নোংরা হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। সরেজমিন দেখা যায়, হাসপাতালের ৭, ৯ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বারান্দার সামনে বেশ কিছু স্থানে স্তূপাকারে ময়লা-আবর্জনা রাখা। কোনো কোনো ওয়ার্ডের সামনে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেও দেখা যায়। এসব আবর্জনা থেকে সারাক্ষণ উৎকট গন্ধ ছড়ায়। এর আগে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে হঠাৎ পরিদর্শনে গিয়ে টয়লেটগুলোর বেহাল দশা দেখে ক্ষুব্ধ হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সরেজমিন ঘুরে মন্ত্রী দেখতে পান, টয়লেটগুলো নোংরা, অস্বাস্থ্যকর ও ব্যবহারের অনুপযোগী। ওয়ার্ডগুলোর দেয়ালের রং খসে কুিসত রূপ নিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এগুলো দ্রুত সংস্কারের নির্দেশ দিয়ে বলেন, দায়িত্ব পালনে কোনো রকম গাফিলতি ও অনিয়ম সহ্য করা হবে না। পরে সেখানে ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়াদের সমন্বয়ে হাসপাতাল এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চমৎকার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরিচ্ছন্নতার অভিযান চার-পাঁচ মাস কার্যকরও ছিল। কিন্তু আবার সবকিছুই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী, নার্স ও ডাক্তারদের বিছানাপত্র এবং অ্যাপ্রোনসহ ব্যবহূত কাপড়চোপড় নোংরা, দূষিত পচা পানিতে ধোয়া হচ্ছে। রোগীর মলমূত্র, পুঁজ আর রক্তমাখা এসব কাপড়চোপড়, চাদর, বালিশের কাভার কোনোমতে ধুয়ে শুকানোও হচ্ছে নোংরা পরিবেশেই। ভালোভাবে পরিষ্কার না করায় জীবাণুসহ নোংরা অবস্থায় চাদর, কম্বল, বালিশের কভার ইত্যাদি রোগীদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হচ্ছে।

সরকারি-বেসরকারি গলাগলি : নিয়ম আছে সরকারি হাসপাতালের ৩০০ গজের মধ্যে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক থাকতে পারবে না। এ নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের, যেগুলোর বেশির ভাগের অবস্থান সরকারি হাসপাতালের ১০০ গজের মধ্যে। এ অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি হওয়ায় দালালরা রোগীদের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে ভর্তি করে। ফলে রোগীরা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছাকাছি অবস্থিত বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে চানখাঁরপুল জেনারেল হাসপাতাল, চৌধুরী ক্লিনিক, রাফাত জেনারেল হাসপাতালের মৌসুমি ক্লিনিক ও সেবা মেটারনিটি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনেই অবস্থিত নিউ ঢাকা ক্লিনিক, আরাফাত মেডিকেল প্রাইভেট লিমিটেড, ডক্টরস ক্লিনিক, আলফা ডায়াগনস্টিক হাসপাতাল, ঢাকা হাসপাতাল, নিউ ঢাকা মডার্ন ক্লিনিক, রেজিয়া ক্লিনিক ও আল আরাফাত ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি হাসপাতালের সামনে অবস্থান ট্রমা সেন্টারের। স্পেশালাইজড সার্জারি ল্যাপারোস্কোপি অ্যান্ড ইউরোলজি ক্লিনিক, পরীবাগের মডার্ন মেটারনিটি ও কবির নার্সিং হোম গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালকে ঘিরে। ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালগুলোর আশপাশে আরও খারাপ অবস্থা। রাজধানীঘেঁষা টঙ্গী আধুনিক হাসপাতালের প্রধান গেট জুড়েই সারি সারি ক্লিনিক, নার্সিং হোম। এসব ক্লিনিকের দালালরা হরদম সরকারি হাসপাতালের গেটজুড়ে অবস্থান করে থাকে। কোনো রোগী সেখানে পৌঁছালেই নানা ফন্দিফিকিরে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। ফলে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পান না। অথচ বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হয় তাদের।

সংসদীয় কমিটিতেও ক্ষোভ : এবার সংসদীয় কমিটির সদস্যরাই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের অভাব ও সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বড় বড় সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব, মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার না থাকাসহ নানা অরাজকতার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। এ সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মফস্বলে যেসব ডাক্তারকে বদলি করা হয়, তারা নানা অজুহাতে ডেপুটেশনে রাজধানী বা বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে চলে আসেন। ফলে জনগণ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। কমিটি তাত্ক্ষণিক ডেপুটেশনে বদলি বন্ধের সুপারিশ করেছে। সভায় কমিউনিটি ক্লিনিকে গরিব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক ওষুধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থা মনিটর করার সুপারিশ করা হয়। সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ৩৪তম বৈঠকে ডাক্তারদের বিষয়ে নানা পর্যালোচনা শেষে এসব সুপারিশ করা হয়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি হাসপাতালের সেবার মান আগের চেয়ে এখন অনেক উন্নত। আমরা যে শতভাগ সফল হতে পেরেছি তা বলব না। তবে সরকারের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। এ জন্য ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আরও ১০ হাজার নতুন ডাক্তার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এখানে একটা বিষয় না বললেই নয়, আমাদের যে জনসংখ্যা সে অনুপাতে রোগীর যে সংখ্যা সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় হাসপাতাল ও ডাক্তারের চাহিদা পূরণ করা সত্যিই কষ্টকর। তবে সরকার কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলা-উপজেলা, বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে নতুন নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা যেন যথাসময়ে উপস্থিত থাকেন সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিউটির সময়ে ভিজিটর (রিপ্রেজেন্টেটিভ) নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিকল যন্ত্রপাতি দ্রুত মেরামত করা হচ্ছে। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোতে দালাল চক্রের যে সিন্ডিকেট ছিল সেগুলোও নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে আগের চেয়ে দালাল চক্রের হয়রানি অনেকাংশে কমেছে বলে তিনি দাবি করেন। এ ধরনের কোনো ঘটনা কোথাও ঘটে থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকেও যথেষ্ট নজর দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর