শিরোনাম
সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১০৭

নিখুঁত ছকেও পার পেল না খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

নিখুঁত ছকেও পার পেল না খুনি

মধ্যরাতে ঘরে আগুন। ঘরের ভিতর আটকা পড়েছে তিনজন। বিল্লাল তার স্ত্রী আর তাদের দুই বছরের শিশু কন্যা মোহনা। বিল্লালের আর্তচিৎকার। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ঘর আর তিনটি মানুষ। বাঁচাও, বাঁচাও আগুন, চিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে আসছে তাদের রক্ষায়। পাড়া প্রতিবেশীরা যে যেভাবে পারছে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কয়েক ব্যক্তি ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে। পড়ে ছিল বিল্লাল। তার শরীরের কিছুটা পুড়েছে। পরনের কাপড় পুড়ে কালো। বিল্লালের শরীরও কালি লেগে কালো হয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বিল্লালের স্ত্রী আর শিশু কন্যা আর জীবিত নেই। পুরোটা শরীর পুড়ে গেছে দুজনের। বিল্লালকে রাতেই নেওয়া হলো হাসপাতালে। প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। জ্ঞান ফিরে তার। জানতে চায় স্ত্রী কন্যার কথা। সবাই নীরব। সান্ত্বনা দেয় সবাই তাকে। সে মানে না কিছু। কাঁদতে থাকে। আমার শাহানাজ কোথায় গেলা একা ফেলে। মোহনারে...! তার চিৎকারে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না।

পুলিশ আসে। সকালে লাশের সুরতহাল তৈরি করে পুলিশ। শাহানাজের শরীর পুড়ে গেছে। লিখে যায় পুলিশ তাদের খাতায়। বুক পেরিয়ে গলার কাছে চোখ আটকে যায় পুলিশের। কী ব্যাপার মহিলার গলা তো পুড়ে যায়নি! কিন্তু গলায় ক্ষত কেন? পুলিশের নতুন ভাবনা। কী ব্যাপার গভীর ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে ধারালো কিছুর আঘাত। ভাবিয়ে তোলে পুলিশকে। তবে কী এটা নিছক কোনো আগুন নয়? অন্য কিছু আছে এতে? প্রশ্ন উঁকি দেয় পুলিশের মনে। নাটকীয় মোড় ঘটনার। ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার জয়নগরে এ রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে।

পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করে জানতে পারে এটি একটি হত্যাকাণ্ড। খুনি শনাক্ত হয়। গ্রেফতার হয় খুনি। গোয়েন্দারা জানায়, চলতি বছরের জুনে রমজান মাসে বিল্লালের স্ত্রী শাহানাজ, ইফতার করে ঘরের টুকিটাকি কাজকর্ম সেরে পাশের ঘরে চাচাত জায়ের ঘরে তারাবির নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে তিনি তার ঘরে ফিরে ভাবছিলেন রাতে কী খাবেন? এবং ভোর রাতে কী খেয়ে রোজা রাখবেন। কারণ ঘাতক বিল্লাল একদিন বাজার করে তো দুই দিন করতেন না। সব সময় সে স্ত্রী শানাহাজকে অভাব অনটনেই রেখেছেন। বিল্লাল ড্রাইভিং করে যা ইনকাম করতেন তার বেশির ভাগ পরকীয়ার পেছনেই খরচ করতেন। ওই মুহূর্তে শাহানাজের ঘরে থাকা আগের দিনের কিছু পান্তাভাত লবণ-মরিচ দিয়ে খেয়ে তার দুই বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এটাই ছিল তার শেষ খাওয়া ও শেষ ঘুম! বিল্লাল রাত ১২টার দিকে ঘরে প্রবেশ করেন। ঘরে এসে সে অন্য খাটে শুয়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে মোবাইলে কথা শুরু করে। টের পেয়ে স্ত্রী শাহানাজ উঠে বলল, তুমি সারা দিন বাসায় আসনি। বাজার দেওনি, আমাদের খোঁজখবর রাখনি, এখন আবার অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলছ? এতে বিল্লাল ক্ষিপ্ত হয়ে দুজনের বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে শাহানাজের গলায় ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। এতে শাহানাজ রক্তক্ষরণের পর মৃত্যুর মুখে ঢলে পরে, ওই মুহুর্তে বিল্লাল লাশটি শাহানাজের রুমে নিয়ে তার ঘুমন্ত বাচ্চা মোহনার পাশে রাখে। এরপর এ হত্যাকান্ডটি অগ্নীকার্ড হিসেবে প্রমান করার জন্য প্রথমে ঘর থেকে রক্ত পরিস্কার করে। এবার বিল্লাল নিহত স্ত্রী ও জীবিত বাচ্চার গায়ের উপর কম্বল ও বিভিন্ন কাপড?চোপর ছিটিয়ে দেয়। এরপর বিল্লাল ঘরে থাকা কেরশিনের বোতল থেকে তেল ঢেলে জীবিত মোহনা ও মৃত শাহানাজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। যখন আগুন জলা শুরু হলো ওই মুহুর্তে বাচ্চা মোহনা আগুনের তাপে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু ওই মুহুর্তে নরপশু বিল্লাল নিজে বাঁচার জন্য নিস্পাপ শিশু মোহনাকে উদ্ধার করেনি আগুন থেকে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিল্লালের শেষ রক্ষা হলো না। ওই মুহুর্তে বিল্লাল নিজের পড?নের লুঙ্গী ও গেনজি নিজে পুরে, শরীরে কালি লাগে। আগুন আগুন করে চিৎকার আরম্ভ করে, এতে আশপাশে বাড?ীর অন্যান্ন লোকজন এসে পরলে বিল্লাল ইচ্ছে করে বেহুস হয়ে মাটিতে লুটে পরে। সে প্রশাসন ও বাড?ীর লোকজনকে বুঝাতে চেয়েছে, ঘরে আগুন লেগে স্ত্রী সন্তান পুরে গেছে, তাদের বাঁচাতে যেয়ে সে গুরুতর আহত হয়েছে। পরে স্থানীয়রা বিল্লালকে অসুস্থ্য ভেবে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।

খুনি বিল্লালের ধারণা ছিল, যে ভাবে সে আগুন লাগিয়েছে, তাতে শাহানাজ ও মোহনা পুরে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। আর ভালো ভাবে পুরে গেলে শাহানাজের গলার জবাই করা চিহ্ন খুজে পাবে না কেউ। কিন্তু বিল্লালের এ ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমান হলো। আগুনে শাহানাজের শরীর পুড়লেও গলা পুড়েনি। সকালে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করার সময় দেখে স্ত্রী শাহানাজের গলায় ছুরির আঘাত। এতে পুলিশ ভালো ভাবে বুঝতে পারে। নিশ্চই বিল্লাল এ জোড?া খুন করে বাঁচার জন্য নাটকীয় ভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ওই মুহুর্তে পুলিশ দ্রুত ভোলা সদর হাসপাতাল থেকে ঘাতক বিল্লালকে গ্রেপ্তার করে। এরপর সীকার করে নেয় তার খুন করার কাহিনী।

সর্বশেষ খবর