সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সিনহার পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন

ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে সরকারের রিভিউ আবেদন

নিজস্ব প্রতিবেদক

উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল চেয়ে রিভিউ আবেদন করেছে সরকার। গতকাল সকালে সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করা হয়। রিভিউ আবেদনের নম্বর ৭৫১/২০১৭। সরকারের রিভিউ আবেদন মঞ্জুর করা হলে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বহাল থাকবে। রিভিউ আবেদন দাখিল করার পর নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে ৯৪টি গ্রাউন্ড তুলে ধরা হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে যেসব অপ্রাসঙ্গিক পর্যালোচনা এসেছে, তা বাতিল চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ সংক্রান্ত আইন হওয়ার আগেই আপিলের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে যা আমাদের কাছে অপরিপক্ব মনে হয়েছে। রিভিউ আবেদনে আমরা ওই রায় বাতিল চেয়েছি। আশা করি আপিল বিভাগ রায় পুনর্বিবেচনা করবে এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বহাল থাকবে। মুজিবনগর সরকার ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বরাতে রিভিউ আবেদনে বলা হয়, একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই জাতির পিতা। কিন্তু আদালত এই বিষয়ে ভুল করেছে। আদালত এক্ষেত্রে বহু বচনাত্মক শব্দ ব্যবহার করে বলেছে, ফাউন্ডিং ফাদারস বা একাধিক পিতা। এ জন্য রায় পুনর্বিবেচনা হওয়া দরকার।

প্রধান বিচারপতি সিনহার পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’-এর সংস্কৃতির সমালোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমরা যে অলঙ্ঘনীয় ঐক্য গড়েছিলাম, তা শত্রুরা নস্যাৎ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আজ আমরা একটি মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে বাস করি। অথচ আজ ঔদ্ধত্য এবং অজ্ঞতাকে আমরা প্রশ্রয় দিয়ে চলছি। কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি  দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নে সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে এই আমিত্বর আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা। তিনি বলেছেন, এই বাজে রোগের কারণে নীতিনির্ধারকেরা সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ফেলেছেন। তারা তাদের ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও “মেকি গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এটা তারা লজ্জাজনকভাবে আমাদের সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে করেছেন। অথচ ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়ে এ সংবিধান লিখেছিলেন। আমাদের অবশ্যই এই নোংরা “আমাদের লোক” মতবাদ পরিহার করতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে এই আত্মঘাতী “আমি একাই সব” দৃষ্টিভঙ্গি। এ বিষয়ে রিভিউ আবেদনে বলা হয়, এ ধরনের পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন, অনাবশ্যক, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কলঙ্কিত করে ও এ মামলার বিষয়বস্তুর বাইরে। রিভিউ আবেদন বলা হয়, রায়ের পর্যবেক্ষণে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সমালোচনা করা হয়েছে। পার্লামেন্টকে শিশু বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, জনগণ এই দুটি (নির্বাচন কমিশন ও সংসদ) প্রতিষ্ঠানকে আস্থায় নিতে পারে না। এ বিষয়ে রিভিউ আবেদনে বলা হয়, এ ধরনের বক্তব্য সঠিক নয়। মামলার বিষয়বস্তুর বাইরে। বিচার বিভাগ থেকে আইনসভা সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য অপ্রয়োজনীয়, বিচারিক শিষ্টাচার বিরোধী। পর্যবেক্ষণে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্রকে অপরিপক্ব বলা হয়েছে। বিচারক অপসারণ ক্ষমতা সংসদকে দেওয়াকে আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রের একটি অর্গান হিসেবে বিচার বিভাগ অন্য একটি অর্গান সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের যদি সন্দেহের চোখেই (দলত্যাগ) দেখা হয়, তাহলে তাদের কী করে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের মতো দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজে ন্যস্ত করা যায়? তাই এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যের চেতনা হলো সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা তাঁদের মনোনীত করা দলের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখবেন। আসলে তারা তাদের দলের উচ্চপর্যায়ের হাতে জিম্মি। এ বিষয়ে রিভিউ আবেদনে বলা হয়, সরকার ও সংসদের স্থায়িত্ব এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে। এ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

রিভিউ মঞ্জুর হলে ষোড়শ সংশোধনী বহাল থাকবে —অ্যাটর্নি জেনারেল : সংবাদ সম্মেলনে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে সরকারের আপিল খারিজ করা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দায়ের করেছি। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের রায় বাতিল করে রিভিউ আবেদন মঞ্জুর চাওয়া হয়েছে। রিভিউ আবেদন দ্রুত শুনানির বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সেটা দেখব, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। ষোড়শ সংশোধনী পুনর্বহাল চেয়েছেন এ কথা বলা যায় কিনা এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসলে আমাদের রিভিউ মঞ্জুর করা হলে তাই পুনর্বহাল হবে। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ বাতিলের জন্য যুক্তি দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ৩৯টি কোড অব কন্ডাক্ট করেছিল এ বিষয়ে বলেছি কোড অব কন্ডাক্ট তো রায় দিয়ে করার কথা নয়। এটি চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন করার কথা। তারা (আপিল বিভাগ) যে আচরণবিধি করেছেন, এটি ইস্যু ছিল না। তারা অনর্থক নিজেরা নিজেরা করেছেন। এটি বাতিল চেয়েছি। রিভিউ শুনানিতে আন্তর্জাতিক আইনজীবী চেয়ে আবেদন করার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যারা এ আবেদন করেছেন আমার মতে তারা দেশদ্রোহী। দেশের প্রতি আস্থা থাকলে, দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা থাকলে, দেশের বিচারকদের প্রতি আস্থা থাকলে কোনো আইনজীবী এ আবেদন করতে পারেন না। যারা করেছেন তারা না বুঝেই করেছেন। এ ধরনের পদক্ষেপ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। ২০১৪ সালে সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হলে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাই কোর্টে একটি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানির পর ২০১৬ সালের ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্ট। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ গত ৩ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে। এর ফলে হাই কোর্টের রায়ই বহাল থাকে। ওই রায়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে আনা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে বিচারকদের জন্য একটি আচরণবিধিও ঠিক করে দেয় আপিল বিভাগ। রায়ে প্রধান বিচারপতি সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সংসদ, সংসদ সদস্য, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করেন। সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা। আলোচনা-সমালোচনার একপর্যায়ে বিচারপতি সিনহা ৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে যান। তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দেন রাষ্ট্রপতি। ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন বিচারপতি সিনহা। ছুটি শেষে ১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান বিচারপতি সিনহা। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির যে বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছিল, তার মধ্যে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসরে গেছেন, আর বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পদত্যাগ করেছেন।

সর্বশেষ খবর