বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

নারায়ণগঞ্জ থমথমে কাঁদছে হকাররা

আমৃত্যু গরিব মানুষের পক্ষে থাকব : শামীম ওসমান

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

নারায়ণগঞ্জ থমথমে কাঁদছে হকাররা

হকার নিয়ে মঙ্গলবার ব্যাপক সংঘর্ষের পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) সর্বত্র থমথমে অবস্থা চলছে। নাসিক থেকে উচ্ছেদ হওয়া হকাররা কাঁদছেন আর বলছেন, ‘পুনর্বাসনের জন্য ২৫ দিন ধরে আন্দোলন করেও আমরা কিছু পেলাম না। সপরিবারে অনাহারে আর কত দিন থাকতে হবে তা কে জানে!’ মঙ্গলবারের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের কমিটি করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার মঈনুল হক। অন্যদিকে, নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও এমপি শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে একে অন্যকে সংঘর্ষের জন্য দোষারোপ করেছেন। মেয়র আইভী গতকালও বলেছেন, মঙ্গলবারে পরিকল্পিতভাবে শামীম ওসমানের নির্দেশে তার ওপর হামলা হয়েছে। পক্ষান্তরে শামীম ওসমান বলেছেন, তিনি আমৃত্যু গরিবের পক্ষেই থাকবেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বমানবতার মা হয়েছেন। আর মাত্র এক মাসের জন্য ৫ হাজার গরিব হকার পরিবারের ক্ষুধা নিবারণের জন্য রাস্তায় নামব না, তা হয় না। এজন্য শাস্তি পেতে হলে তা মাথা পেতে নেব।’ তিনি বলেন, মেয়রের সঙ্গে থাকা বিএনপির ক্যাডার ও তার সমর্থকরা হকারদের ওপর হামলা চালানোর কারণেই ওই সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় বিবদমান কোনো পক্ষই মামলা করেনি। সদর মডেল থানার ওসি জানান, মেয়রের বডিগার্ড তিনটি গুলি ছুড়েছেন অভিযোগে থানায় একটি জিডি হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনার সময় নিয়াজুল ইসলাম নামে এক বক্তির লাইসেন্সকৃত পিস্তল খোয়া গেছে এবং তার ওপরে হামলা হয়েছে এ অভিযোগ আনা হয়েছে ১৭ জনের বিরুদ্ধে। গতকাল নগরীর কোনো কোনো সড়কের পাশে গুটিকয় হকারকে বসতে দেখা যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পুলিশ তাদের উঠিয়ে দেয়। এদের মধ্যে আলিম নামে একজন বলেন, ‘নাসিকের লোকজন ২৫ দিন আগেই আমার ব্যবসার কাপড় জব্দ করে পুড়িয়ে দেয়। এখন হাতে কোনো টাকা নেই। ধারদেনা করে চলছি। আমরা তো কোনো সংঘর্ষ চাইনি। তবুও মেয়রের লোকেরা আমাদের পিটিয়েছে। বাড়ির লোকজন না খেয়ে থাকলে তা কি সহ্য হয়? বাধ্য হয়েই তো আমরা ফুটপাথে আসি।’ একই কথা বললেন হকার আজগর মিয়া ও সঙ্গীরা। বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচারের জন্য আল্লাহর দিকে তাকিয়ে আছি।’

নিয়াজুলকে ডিফেন্ড করছি না : শামীম

চাষাঢ়া রাইফেল ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে শামীম ওসমান এমপি বলেন, ‘আমি নিয়াজুলকে ডিফেন্ড করছি না। কিন্তু তিনি আমার লোক বলে মেয়র যা বলছে তা মিথ্যাচার। নিয়াজুলের বড় ভাই আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা নজরুল ইসলাম সুইটকে বিএনপি-জামায়াত আমলে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় নিয়ে গিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছিল। ২০০১-এর পর থেকে নিয়াজুল ছিলেন ঘরছাড়া। দেশে ফিরে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ভাই হত্যার বিচার তিনি পাননি। যে বিএনপি-জামায়াত জোট নজরুলকে হত্যা করেছে তারাই যখন আবার এই আমলে মেয়র আইভীর মতো আওয়ামী লীগারদের পক্ষ নিয়ে নিয়াজুলের ওপর অযথা আক্রমণ চালায় তখন লজ্জা হয় আমাদের।’ শামীম ওসমান এ সময় একটি ভিডিও ও কয়েকটি স্থিরচিত্র দেখিয়ে বলেন, ‘এসব ভিডিও গণমাধ্যমকর্মীরাই তুলেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে নিয়াজুল একাই মেয়র আইভী ও তার দলবলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তাকে তিন দফা সেখানে মারধর করা হয়েছে। এরপর তিনি জীবন রক্ষার্থে তার লাইসেন্স করা পিস্তল বের করেছেন। এরপর তাকে মেরে পাঁজরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তার পিস্তলটি ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেয়রকে মারতে তিনি কি দুই-তিন শ লোকের সামনে একা যাবেন?’

আইনি ব্যবস্থা নেব : আইভী

নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী গতকাল নগর ভবনে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে মঙ্গলবারের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, সেদিন হামলায় তার বোনজামাই, ভাই, কর্মীরা জখম হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মার খেতে প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু কর্মীরা মার খাবেন তা কখনো চাইনি। ধারণা ছিল আমি ওখানে বসা থাকলে কোনো হামলা হবে না। কিন্তু হয়েছে। আমার কর্মীদের টার্গেট করে মারা হয়েছে।’ আইভী বলেন, তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে হাজার হাজার মানুষ আসে। কাউকে তিনি ডেকে আনেননি। তিনি অস্ত্র নিয়ে মিছিলে যাননি। সেলিম ওসমান এমপি চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠির উত্তর দেওয়া হয়েছে। মেয়র বলেন, অন্য আসনের এমপি কেন হকার নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু করলেন। এখানের এমপি তো সেলিম ওসমান। সিটিতে হকার বসবে কি বসবে না তা এমপি, মেয়র, ডিসি, এসপি মিলে বিবেচনা করবে। এখানে তো উসকানি দেওয়ার কিছু নেই। চাষাঢ়া হকার্স মার্কেট করে দিয়েছে নাসিক। প্রয়োজনে সেই মার্কেট ১০ তলা করার পরামর্শ দিয়ে শামীম ওসমান এমপি মেয়রকে সহযোগিতার কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করলেন না। তার লোকজন দিয়ে হামলা করালেন।

 

বঙ্গবন্ধু সড়ক বাদ দিয়ে বসতে হবে, হকারদের ‘না’ : নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের (নাসিক) এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নারায়ণগঞ্জ নগরীর প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়ক ব্যতীত অন্যান্য কয়েকটি সড়কে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হকাররা বসতে পারবে। তবে হকাররা এ সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের বৈঠকে সিদ্ধান্তের কথা গতকাল রাত ১০টার দিকে জানান জেলা পুলিশ সুপার মঈনুল হক। অন্যদিকে হকাররা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতেই বসার দাবি জানিয়েছেন। জেলা পুলিশ সুপার মঈনুল হক জানান, বঙ্গবন্ধু সড়ক ব্যতীত সিরাজউদ্দৌলা সড়ক, নবাব সলিমুল্লাহ সড়ক, চেম্বাররোড, খানপুর হাসপাতাল সম্মুখ সড়কে সাময়িক সময়ের জন্য হকার বসতে পারবে- এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল পাঁচটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হকাররা বেচাকেনা করতে পারবে। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ঢাকায় ডাক পড়েছে শামীম-আইভীর : ঢাকায় তলব করা হয়েছে  মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি এ কে এম শামীম ওসমানকে। এ তথ্য জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে কবে, কোথায় দুজনের সঙ্গে আলোচনা হবে, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি। একই সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও তাদের ডেকেছেন বলে জানান ওবায়দুল কাদের। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জে দুই নেতার দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এই মারামারিতে ভোটব্যাংকের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে এটা খুব খারাপ দৃষ্টান্ত।

আমি গতকাল রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। এদের দুজনকেই ডাকা হয়েছে। এটা পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমরা অভ্যন্তরীণভাবে কথা বলব।

ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, যারা এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তদন্ত চলছে। যারা জনসম্মুখে পার্টির ভাবমূর্তি নষ্ট করে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা কেউ ছাড় পাবে না। এই দুজনকে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বসবেন।

সর্বশেষ খবর