শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
কী হচ্ছে উপকমিটি নিয়ে

আওয়ামী লীগে ছাত্রদলের ক্যাডার, মাদকসেবী

রফিকুল ইসলাম রনি

জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের গত কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন সংগীতশিল্পী এস ডি রুবেল। ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের এই নেতা এবার স্থান পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিকবিষয়ক উপকমিটিতে। তাকে ওই কমিটির সহসম্পাদক করা হয়েছে। ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদ গ্রুপের অস্ত্রধারী ক্যাডার কে এম কবির হোসেন হয়েছেন দফতর উপকমিটির সহসম্পাদক। ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহসম্পাদক হয়েছেন ছাত্রদলের অস্ত্রধারী ক্যাডার এইচ এম মিজানুর রহমান জনি। শুধু ছাত্রদলের এসডি রুবেল, কবির, জনিই নন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে স্থান পেয়েছেন মাদক ব্যবসায়ী, ধর্ষকও। এ ছাড়া উপকমিটিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের আজ্ঞাবহদের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। বঞ্চিত হয়েছেন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত সাবেক ছাত্রনেতারা। আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি ঘোষণা করা না হলেও ‘মিডিয়ার সমালোচনা এড়াতে’ গোপনে চিঠি দেওয়া হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্তদের। তবে দফতর সূত্র জানিয়েছে, তারা এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি সম্পন্ন করেনি। এখনো প্রস্তাবিত। চূড়ান্ত অনুমোদনের পর সংবাদ সম্মেলন ডেকে তা প্রকাশ করা হবে।  গত বুধবার বেলা ১টার দিকে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে দেখা যায়, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হেমায়েত উদ্দিন প্রস্তাবিত কমিটি নিয়ে  হৈচৈ করছেন। তিনি বলছিলেন, ‘গত সাত বছরে অনেক কষ্ট করেছি। দলের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছি। কিন্তু কী পেলাম? রাজপথে ঘাম ঝরাই আমরা, আর পদ পায় ছাত্রদল-শিবির ক্যাডাররা? অনেক ধৈর্য ধরেছি-এবার সব গোমর ফাঁস করব কিন্তু।’ এ সময় হেমায়েতকে শান্ত করেন এক কেন্দ্রীয় নেতা। ওই কেন্দ্রীয় নেতা হেমায়েতকে শান্ত করে বলেন, ‘লেগে থাক, রাজনীতিতে কখন কে কোথায় যায় বলা মুশকিল।’ একটি সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের ১৯টি সম্পাদকীয় পদে ১০০-এর ওপরে সহসম্পাদক করা হয়েছে। আর এই কমিটির অধীনে সদস্য করা হয়েছে এক হাজারের ওপরে। কেন্দ্র ঘোষণা না করলেও গত বুধবার থেকেই সহসম্পাদক ও সদস্যপদ পাওয়া নেতাদের অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ১৯টি উপকমিটির মধ্যে প্রায় ১০টি কমিটির তালিকা বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে এসেছে। ওইসব কমিটি পর্যালোচনা করে এবং সাবেক ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘোষিত কমিটিতে ছাত্রদল, ধর্ষক, জমির দালাল, নেতাদের আজ্ঞাবহদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আবার কখনো রাজনীতি করেনি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিল না, এমন ব্যক্তিকেও উপকমিটির প্রথম সারিতে রাখা হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যকে নিচের দিকে নাম রাখা হয়েছে। নেতাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের গাড়িতে যারা প্রটোকল দেন তারাও স্থান পেয়েছেন এই উপকমিটিতে। কমিটি গঠনে কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী সদস্যদের সুপারিশও উপেক্ষিত হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে ছাত্রদলের সাবেক নেতা কে এম কবির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা পদ-পদবি পায়নি তারাই আমার নামে মিথ্যাচার করছে। ২০০১ সালে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদ ভাইয়ের বাড়ি পটুয়াখালী। আমার বাড়িও পটুয়াখালী। সেই সুবাদে পরিচয় ছিল। আমি কখনো ছাত্রদল করিনি।’ এক সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে তিনজন সহসম্পাদক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনই ছাত্রদলের ক্যাডার। একজন জমির দালাল হিসেবে পরিচিত। আবার তিনি ‘হোয়াইট’ ম্যান হিসেবেও পরিচিত। এদের মধ্যে মিজানুর রহমান জনি ছাত্রদলের ঢাকা কলেজের একজন অস্ত্রধারী ক্যাডার ছিলেন। ৯০-পরবর্তী সময়ে ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সিরাজের গ্রুপের একজন সক্রিয় অস্ত্রধারী ক্যাডার ছিলেন তিনি।  জনির বাবা আবদুল হক হাওলাদারও বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। আরেক বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের উপকমিটিতে স্থান পাওয়া এক সহসম্পাদক মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ করেছিলেন উপাচার্যের কাছে। সে খবর দেশের জাতীয় সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। সে ছাত্রলীগের নামধারী তথাকথিত এক কর্মী ছিল। অর্থ ও বাণিজ্য উপকমিটিতে স্থান পেয়েছেন চট্টগ্রামের এক এমপির ছেলে নাজমুল কমির চৌধুরী সারুন। তিনি ১১ নম্বর সদস্য হয়েছেন। যার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন ইতিমধ্যে তদন্ত করেছিল। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বড় কোনো পদে ছিলেন না কখনো। আর এই কমিটিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. অনুপমকে করা হয়েছে ১৭ নম্বর সদস্য। এস ডি রুবেল বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। এ ছাড়া ছাত্রজীবনে ঢাকা কলেজে ছাত্রদলের নেতা ও ক্যাডার হিসেবে পুরো ছাত্রজীবন পার করেছেন। এমনকি এস ডি রুবেল ছাত্রদলের ঢাকা কলেজ শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদকও ছিলেন। এস ডি রুবেল যখন ছাত্রদল করতেন সে সময় ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের একাধিকজন উপকমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রুবেলের হাতে ছাত্রলীগের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী নির্যাতিত হয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রদলের ঢাকা কলেজের সাবেক ক্যাডার জিপসি রুবেলও ঠাঁই পেয়েছেন। ২০০৬ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনের ওপর হামলাকারী ফয়সাল আহমেদ রিয়াদ এখন আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক। তাকে দফতর কমিটিতে সহসম্পাদক করা হয়েছে। ছাত্রলীগ যখন ক্যাম্পাসে অবস্থান নিতে চায়, তখন ছাত্রলীগকে ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে প্রতিহত করেন রিয়াদ। শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটিতে সহসম্পাদক করা হয়েছে জাপানি ফারুককে। তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে ছিলেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতালি আমান হিসেবে পরিচিত আমানকে সিলেট বিভাগের সহসম্পাদক করা হয়েছে। নিয়ম না থাকলেও জেলা ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকা নেতাদের সহসম্পাদক করা হয়েছে। ছাত্রলীগের এক সভাপতি দফতর উপকমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু সেই নেতার মেয়াদকালে যারা বিভিন্ন ইউনিটের পদধারী নেতা না হয়ে কর্মী ছিলেন এমন কয়েকজন সহসম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। গতকাল আওয়ামী লীগের দুজন কেন্দ্রীয় নেতা বললেন, আমাদের সাধারণ সম্পাদক সাহেব আগে বলতেন- ‘যার গায়ে ধাক্কা লাগে সেই সহসম্পাদক।’ আর এখন যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, সেই উপকমিটির সহসম্পাদক না হয় সদস্য। যারা পদ-পদবি পেয়েছেন তাদের অনেককেই জীবনে দেখিনি। 

২০তম সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়ে গত ২৬ অক্টোবর ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দলের গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০০ করার যে বিধান রয়েছে, আমরা তার বাইরে যাব না। এই কমিটির সদস্য সংখ্যা একশর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।’

সর্বশেষ খবর