রবিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

যানজটে বিপর্যয় ঢাকায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

যানজটে বিপর্যয় ঢাকায়

রাজধানীর ৩৭টি পয়েন্টে ২৪ কারণে হরহামেশা যানজট লেগেই থাকছে। দুঃসহ এই জটে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে রাজধানী। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়ক, মোড়, ট্রাফিক পয়েন্ট ও রেলক্রসিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা মানুষজন সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। প্রধান সড়কের ভয়াবহ যানজট মুহূর্তে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে অলিগলি মহল্লায়। এই বাস্তবতায় ঢাকা নগরীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাতায়াতে পুরো দিন লেগে যাচ্ছে। বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কার, রিকশা ব্যবহার করেও কতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে- তার উত্তর কারও জানা থাকছে না। অর্থাৎ ঢাকার পথে নামা মানেই অনিশ্চিত যাত্রা। অথচ নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর রেলক্রসিংসমূহে ছোট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস নির্মাণ এবং ২০-২২টি ইউলুপ নির্মাণ করলেই যানজট অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এসব ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের কোনো উদ্যোগও নেই, নজরও নেই। ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবে রাস্তার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বেশি। আবার গাড়ির তুলনায় যাত্রীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। যে কারণে নগরীতে যানজট সামাল দেওয়া কঠিন। এরপরও প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি নামছে, কিন্তু রাস্তা বাড়ছে না। এমন অবস্থায় প্রতিটি সড়কের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। এর সঙ্গে রিকশাসহ অনুরূপ যানের ব্যাপকতা তো আছেই। সব মিলিয়ে বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজন যানজট নিরসনে কাজ দিচ্ছে না। অত্যাধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা, বিভিন্ন সড়ককে ওয়ানওয়ে করা, ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের ব্যাপক কর্মকাণ্ডও এ অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ছে। এদিকে রেলক্রসিংয়ের কারণে রাজধানীর খিলগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, সোনারগাঁও-এফডিসি ও মহাখালীতে যানজটের মাত্রা অনেকাংশে বেড়ে যাচ্ছে। এসব স্থানে চরম অব্যবস্থাপনাও রয়েছে। প্রতিটি ট্রেন আসার আগে-পরে পাঁচ মিনিট করে ১০ মিনিট এবং ট্রেনের ক্রসিং সময় মিলিয়ে ১১-১২ মিনিট লেগে যাচ্ছে। কাছাকাছি সময়ে দুটি ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় একটি ট্রেন ক্রসিং হলেও অন্য ট্রেন আসার অপেক্ষায় গেট আটকানোই থাকে। রেলওয়ে সূত্র বলছে, রাজধানীর ২৯টি রেলক্রসিং পেরিয়ে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৭৩টি ট্রেন চলাচল করে। গড়ে ২০ মিনিট অন্তর ট্রেন চলাচল করে। তবে পুলিশের হিসাবে, প্রতি ১২ মিনিট অন্তর অন্তর রেলক্রসিং আটকে যায়। এ সময় উভয় পাশে গাড়ির জট বাঁধে। এ ছাড়াও ভাঙাচোরা, খানাখন্দে পূর্ণ রাস্তার একাংশ বেদখল এবং অর্ধেক রাস্তাজুড়ে থাকা শত শত গাড়ির এলোপাতাড়ি পার্কিং, যান চলাচলে সমন্বয়হীন রুট পারমিট প্রদান, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল, যানবাহনের বেপরোয়া ওভারটেকিং, মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, চালকদের আইন মেনে না চলার প্রবণতা, রাস্তায় মাত্রাতিরিক্ত রিকশা চলাচল, অপ্রশস্ত সড়ক, রাস্তা ও ফুটপাথজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য-পার্কিং-স্টপেজ দেওয়া, যত্রতত্র ট্রাকস্ট্যান্ড, রেলগেট, হিউম্যান হলারের মাত্রাধিক্য যানজটকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে। এ ছাড়াও আছে পদে পদে জঞ্জাল ও সীমাহীন বিশৃঙ্খলা। চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য আর ট্রাফিক পুলিশের টু পাইস কামানোর ঘটনাও যানজটকে দীর্ঘায়িত ও জিইয়ে রাখার জন্য দায়ী।

ভয়ঙ্কর রোডের আতঙ্ক : রাজধানীর শুধু গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মোড় ও ট্রাফিক ক্রসিংগুলোতে কয়েকশ গজ আয়তনের যানজট সৃষ্টি হলেও চিহ্নত কয়েকটি রোডের পুরোটাই যানজটে আটকে থাকছে। এসব রোড নিত্য যাতায়াতকারী মানুষজনের কাছে আতঙ্কের নাম। এর মধ্যে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার রোড, শনির আখড়া-যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার, গুলিস্তান-নবাবপুর-সদরঘাট পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার, শাহবাগ রূপসী বাংলা হোটেল মোড়-বাংলামোটর-সোনারগাঁও মোড় হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, নীলক্ষেত মোড়-নিউমার্কেট-কলাবাগান পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার, দক্ষিণ কমলাপুর-ধলপুর-সায়েদাবাদ ব্রিজ পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার, বনানী ক্রসিং-মহাখালী-নাবিস্কো বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রোড যাত্রীদের কাছে ‘ভয়ঙ্কর স্থান’ হিসেবে পরিচিত। সায়েদাবাদ জনপথ মোড় থেকে মুগদা স্টেডিয়াম, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মোড় থেকে আবদুল্লাহপুর, আসাদগেট-শ্যামলী, টেকনিক্যাল-গাবতলী, যাত্রাবাড়ী থেকে শ্যামপুর ব্রিজ পর্যন্ত রোড যানজটের স্থায়ী পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত। এসব স্থানে সূর্যোদয়ের আগে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। ফলে জ্যাম-দুর্ভোগ থেকে কারও নিস্তার মেলে না।

যত্রতত্র পার্কিং : গুলশান-বনানীর রাস্তা, অলিগলি সর্বত্রই কয়েক সারিতে গাড়ি পার্কিং করে রাখায় রাজধানীর অভিজাত ওই এলাকাজুড়ে চলছে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা। সেখানে দুঃসহ যানজটে স্থবির হয়ে পড়ছে জীবনযাত্রা। রাস্তার ওপর শত শত গাড়ির এলোপাতাড়ি পার্কিংকে কেন্দ্র করে যানজট ভয়াবহতার সূত্রপাত ঘটছে। রিকশার তাণ্ডব তো আছেই। দিন নয় মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা বিরাজ করলেও এর ধকল থেকে রেহাই দিতে দায়িত্বশীল মহলের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং গুলশান-২ থেকে বনানীর কাকলী পর্যন্ত নিষিদ্ধ বেবিট্যাক্সি ও নম্বর প্লেটবিহীন কয়েকশ সিএনজি দেদার যাত্রী বহন করে চাঁদাবাজি জিইয়ে রেখেছে। এর মধ্যে ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের মালিকানাতেই রয়েছে ৪০-৪২টি সিএনজি। একইভাবে লিং রোড থেকে গুলশান-১ হয়ে মহাখালী আমতলী রোডেও কয়েকশ নিষিদ্ধ গাড়ির অবাধ চলাচল রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন অর্ধ লক্ষাধিক টাকার চাঁদাবাজি ঘটে বলে জানা গেছে। প্রগতি সরণির নর্দা বাসস্ট্যান্ড থেকে শাহজাদপুর পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটার রাস্তায় তিনটি ইউলুপ ও রাস্তা ক্রসিং থাকায় যানজটের ভয়াবহ ধকল থেকে রেহাই মিলছে না। রাত-দিনের বেশির ভাগ সময় আটকে থাকা যানজটের বিস্তৃতি ঘটছে বারিধারার কূটনৈতিক এলাকায়ও। একই ধরনের ধকল পোহাতে হচ্ছে উত্তর বাড্ডা ও লিংক রোডেও। রাত ৮টার পর মহাখালী টার্মিনাল থেকে মহাখালী মোড় পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে তিন সারিতে শত শত কোচ পার্কিং করে রাখা হয়। ফাঁকা রাখা সামান্য একচিলতে রাস্তা দিয়ে প্রাইভেট কার-মাইক্রো যাতায়াতও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাফিকের মহাখালী জোনের এসি আশরাফউল্লাহ গাড়িপ্রতি দৈনিক ১০০ টাকা হারে মাসোয়ারা আদায়ে  ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে রাস্তা পরিণত হয়েছে স্থায়ী পার্কিং জোনে। প্রতি রাতে পিজিস নামের এক সার্জেন্ট পার্কিং করা গাড়ি থেকে মাসোয়ারার টাকা আদায় করেন। যানজট আর অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে বঙ্গবাজারের সামনে থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ফুলবাড়িয়ার প্রশস্ত রাস্তাটি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। স্থানটি মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কাপাসিয়া, কালিগঞ্জ, সাভার-ধামরাইসহ ৩০টি রুটের শত শত বাস-মিনিবাসের স্থায়ী পার্কিংস্থলে পরিণত হয়েছে। ফলে গোটা সড়কটি টার্মিনাল না স্ট্যান্ড, নাকি হাটবাজার- তা ঠাহর করা যায় না। গুলিস্তানের সব রাস্তা-ফুটপাথই থাকে হকারদের দখলে। পুরান ঢাকার প্রধান সড়ক নর্থ-সাউথ রোডের অর্ধেকটা অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে সংলগ্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে নিত্য-ভোগান্তি : রাজধানীর স্কুলগুলোর সামনে ছাত্রছাত্রী অভিভাবকদের জটলা, এলোমেলো গাড়ি পার্কিং, প্রাইভেট কার, রিকশার ইচ্ছামতো ঢোকা ও বেরিয়ে যাওয়া, তীব্র হর্ন, অফিসগামীদের যন্ত্রণাদায়ক প্রতীক্ষা— এসব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর অবস্থা ঢাকা শহরে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। ভোগান্তির শিকার হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীসহ পথচারী ও এলাকাবাসী। বড় বড় রাস্তার যানজট পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত ভিতরের দিকের রাস্তায়, এমনকি আবাসিক এলাকাগুলোতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে যানজটের ভোগান্তিও অসহনীয়। যানজটের এমন কিছু দৃশ্য নিত্যদিনই চোখে পড়ে সিদ্ধেশ্বরী, কাকরাইল, মতিঝিল, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন স্কুলের সামনে। ভিকারুন নিসা নূন স্কুলে সন্তান নিয়ে যাওয়া অভিভাবকদের ভোগান্তির শেষ নেই। স্কুল শুরুর সময় এবং ছুটির পর স্কুলের আশপাশে দেড়-দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রিকশা, গাড়ি, মানুষের ভিড়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। অভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, গভ. ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, ধানমন্ডির ওয়াইএমসিএ স্কুল, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কাকরাইল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, মতিঝিল বয়েজ এবং গার্লস হাইস্কুল, উত্তরার স্কলাস্টিকাসহ দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে।

প্রাইভেট কার বেড়েই চলেছে : রাজধানী ঢাকায় ভয়াবহ যানজটের আরেকটি কারণ অভিজাত শ্রেণির দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরে অর্ধ লক্ষাধিক প্রাইভেট গাড়ির আনাগোনা। এসব গাড়ি শুধু শিক্ষার্থীকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া বা স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার কাজেই ব্যবহার হয় না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গাড়ি দিনভর স্কুলের আশপাশের রাস্তায় কয়েক সারিতে পার্কিং করে অপেক্ষায় থাকে। ধানমন্ডি, গুলশান, মতিঝিল, উত্তরা, মোহাম্মদপুরের বেশ কয়েকটি রোড শুধু স্কুলকেন্দ্রিক প্রাইভেট কারের জন্য অচল পড়ছে। এসব রাস্তায় যানবাহন চলাচল তো দূরের কথা, গাড়ির সারি পেরিয়ে পায়ে হেঁটে চলাও দুষ্কর হয়ে পড়ছে। ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত প্রাইভেট কারের উপস্থিতি। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশই প্রাইভেট কার। কোনো কোনো পরিবারের ৩-৪টি প্রাইভেট কার রয়েছে। একটি রিপোর্টে দেখা যায় যে, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪.২ শতাংশ জায়গা দখলে রাখে প্রাইভেট কার। এত প্রাইভেট কারের পরও প্রতিদিন অগণিত নতুন প্রাইভেট কার চালুর ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে।

৩১ ট্রাফিক ক্রসিংয়ের বেহাল দশা : ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ রাজধানীর ৩১টি ট্রাফিক ক্রসিংয়ের বেহাল অবস্থা দূর করলেও সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সংযোগ সড়কে যানজটের হতশ্রী অবস্থা দিনভর থাকছে। এ সড়কগুলো হচ্ছে মগবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, কাকরাইল, বেইলি রোড, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি ৩ নম্বর, কলাবাগান, গাউছিয়া মার্কেট, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ব্রিজ, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, টয়েনবি সার্কুলার রোড, ফুলবাড়িয়া, ইংলিশ রোড, নয়াবাজার, সদরঘাট, নবাবপুর, মালিবাগ রেলগেট, খিলগাঁও রেলগেট, মুগদা, দৈনিক বাংলা মোড়, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর বিআরটিসি টার্মিনাল, মিরপুর রোড, মিরপুর গোলচক্কর থেকে কচুক্ষেত, সোনারগাঁও রেলক্রসিং ও বিমানবন্দর এলাকা।

কনটেইনারবাহী ট্রেইলারের দখল : রাজধানীর সবুজবাগ বৌদ্ধমন্দির থেকে টিটিপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত বিশ্বরোডের দুই পাশ দখল হয়ে গেছে। বড় আকারের  কনটেইনারবাহী ট্রেইলারগুলো বিশ্বরোডে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকায় প্রতিদিন কম করে ছোট বড় ৭-৮টি করে দুর্ঘটনা ঘটছে। কমলাপুর শহীদ মোস্তফা স্টেডিয়ামের সামনে থেকে খিলগাঁও যাওয়ার বিশ্বরোডের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ২৫ ও ৪৫ ফুট দীর্ঘ এবং ১০ ফুট প্রস্থের দুই ধরনের ট্রেইলার গাড়ি বিশ্বরোডের দুই পাশের অর্ধেক জায়গা দখল করে রেখেছে। এ রোডে চলাচল করা যানবাহনের চালকরা জানান, রাস্তা দখল করে বড় বড় ট্রেইলার গাড়ি রাখায় মাঝে মাঝেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার জন্য গাড়ির চালকদের দায়ী করা হলেও যারা সড়ক দখল করে- তাদের দোষ হয় না। কারণ, পুলিশ ট্রেইলার প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা মাসোয়ারা হাতিয়ে রোডের ওপর পার্কিং করার সুযোগ দেয়।

ইউলুপেই কমবে ২৫ শতাংশ যানজট : বিশেষজ্ঞদের মতে, তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত যে ১২টি সড়ক মোড়ে সরাসরি রাইট টার্ন ক্রসিং রয়েছে, সেগুলোই শুধু ইউলুপে পরিণত করা হলে ২৫ ভাগ যানজট কমে যাবে। রাজধানীর যানজট নিয়ে মাসব্যাপী জরিপ শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরাসরি রাইট ক্রসিংগুলো সব ইউলুপে পরিণত করা হলে এবং রেলক্রসিংসমূহে ছোট ছোট ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস করা হলে ঢাকার যানজট অর্ধেকে নেমে আসবে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় সিটি করপোরেশন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। যদিও রাজধানীর গুলশান থেকে হাতিরঝিল হয়ে রামপুরামুখী যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে মধ্যবাড্ডায় ইউলুপ নির্মাণের কাজ শুরু হয়, কিন্তু দুই বছরেও কাজ শেষ হয়নি। বরং নির্মাণ কাজ চলায় ওই পয়েন্টে যানজট আরও তীব্র হয়েছে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে নগরবাসীর।

শাখা রাস্তা সবই বেহাল : ঢাকায় যানবাহন চলাচলের প্রধান প্রধান রাস্তা ছেড়ে শাখা রাস্তাগুলোতে প্রবেশ করার কোনো উপায় নেই। সেসব রাস্তার প্রবেশ মুখেই শত শত থ্রিহুইলার, নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, অটোরিকশা-ভ্যানের গাদাগাদি আর দোকানপাটের পসরা। এগুলো ঠেলে এবং জন জট পেরিয়ে যেতে যে কারোরই নাভিশ্বাস ওঠে। অভিযোগ অনুযায়ী, সে ফ চাঁদাবাজির কারণে রাজধানীর সর্বত্র চলাচল করছে লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা। নিয়ন্ত্রণহীন এসব গাড়ির কোনো বৈধতাই নেই। প্রতিটি শাখা রোডের মুখেই গাড়িগুলোর সীমাহীন জটলা থাকছে। তা গলিয়ে গাড়ি নিয়ে কেউ ঢুকে পড়লে তার দুর্ভোগের অন্ত থাকছে না। শাখা রোডগুলোর বিশৃঙ্খলা-জট প্রায়ই প্রধান রাস্তাজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে। তখন শত শত যানবাহন আটকে পড়ে অনিশ্চয়তার বেড়াজালে।

যানজট নিরসনে নতুন সড়ক : জানা গেছে, রাজধানীর যানজট নিরসনে ঢাকার পূর্বপাশ দিয়ে ১১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৪ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে রাজধানী ঘিরে বৃত্তাকার ৯১ কিলোমিটারের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। অর্থাৎ রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ না করে যে কোনো যানবাহন সড়ক পথে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে পারবে। আশা করা হচ্ছে এতে রাজধানীর যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। এ ব্যাপারে পানি নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সঙ্গে ইস্টার্ন বাইপাস বহুমুখী সড়ক সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। সরকারের অনুমোদন পেলেই প্রকল্পটির কাজ শুরু হবে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। এদিকে ঢাকাকে ঘিরে বৃত্তাকার নৌরুট থাকলেও পূর্ণাঙ্গ কোনো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে বৃত্তাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে ব্যাপক সাড়া ফেলবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ২৪ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণের ফলে উভয় পাশের সংযুক্তিতে বৃত্তাকারে তা মোট ৯১ কিলোমিটারে পরিণত হবে। অর্থাৎ আবদুল্লাহপুর থেকে তেরমুখ, তেরমুখ থেকে পূর্বাচল হয়ে ডেমরা, ডেমরা থেকে শিমরাইল দিয়ে সাইনবোর্ড হয়ে বিশ্বরোড-চাষাঢ়া, চাষাড়া থেকে ফতুল্লা হয়ে শ্যামপুর-সদরঘাট, সদরঘাট বাবুবাজার হয়ে গাবতলী, গাবতলী থেকে বিলুরিয়া-ধউর হয়ে আবদুল্লাহপুর রুট হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর