বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অবরুদ্ধ ভিসিকে উদ্ধারে গিয়ে ছাত্রলীগের ব্যাপক সংঘাত, আহত শতাধিক

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল সংঘর্ষে দুই পক্ষ। ভিসির কক্ষের গেট ভেঙে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী’ ব্যানারে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে হামলা, ভাঙচুর ও উপাচার্যকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল দুপুরে এ হামলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অবরুদ্ধ উপাচার্যকে উদ্ধার করতে শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন, মলচত্বর, সূর্যসেন হলসহ আশপাশ এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন আন্দোলনকারীরা।

এদিকে আন্দোলনে ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ এনেছে ছাত্রলীগ। হামলায় বাম ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সাধারণ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছয়জনের অবস্থা গুরুতর। তারা ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি রয়েছেন। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীদের হাতে প্রায় এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকেন ঢাবি উপাচার্য। এ সময় তারা উপাচার্যকে লাঞ্ছিত ও উপাচার্য কার্যালয়ের তালা ভাঙচুর করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৫ জানুয়ারি সাত কলেজের অধিভুক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভের সময় আন্দোলনকারী ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের নিপীড়নকারীদের বিচার দাবিতে গতকাল বেলা ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন বাম ছাত্র সংগঠনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী তারা মিছিল নিয়ে উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও করতে যান। মলচত্বরসংলগ্ন উপাচার্য কার্যালয়ের প্রথম গেটের সামনে গিয়ে জড় হন। এ সময় গেট বন্ধ থাকায় তারা তালা ভাঙচুর করে কার্যালয়ের সামনের গেটে গিয়ে সমবেত হন। তারা সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং নিপীড়নকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বহিষ্কারসহ তিন দফা দাবি জানান। এ সময় উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান তার কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন। এরপর দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা রড দিয়ে কার্যালয়ের দ্বিতীয় গেটটির তালাও ভেঙে ফেলেন। এরপর কিছুক্ষণ সেখানে বিক্ষোভ করেন এবং স্লোগান দিতে থাকেন। দুপুর দেড়টার দিকে আন্দোলনকারীরা উপাচার্য কার্যালয়ের তৃতীয় গেট ভেঙে কার্যালয়ের সামনে বসে পড়েন। তারা সেখানে মাইক নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

এরপর বিকাল ৩টার দিকে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান একাডেমিক মিটিংয়ে যোগ দিতে সিনেট ভবনে যাওয়ার জন্য বের হলে আন্দোলনকারীরা তাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। প্রায় এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ও ঢাবি শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ কয়েকজন নেতা উপাচার্যকে উদ্ধার করতে যান। এ সময় উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করেন আন্দোলনকারীরা। এক আন্দোলনকারী উপাচার্যের গায়ে হাত তোলেন এবং কয়েকজন তাকে ধাক্কা দেন। পরে ছাত্রলীগ নেতারা আন্দোলনকারীদের ধাক্কা দিয়ে উপাচার্যকে উদ্ধার করে তার কার্যালয়ে নিয়ে যান।

এদিকে আন্দোলনে ছাত্রদল ও বাম ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণ এবং উপাচার্য লাঞ্ছিত হওয়ার খবর পেয়ে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগ নেতারা রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে রেজিস্ট্রার ভবনের চারপাশ ঘিরে ফেলেন। এ সময় কেন্দ্রীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ইউনিটের প্রায় এক হাজার ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী কয়েকটি ভাগে বিভক্ত আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান বলে অভিযোগ উঠেছে। আন্দোলনকারীদের রেজিস্ট্রার ভবনের ভিতরে বেধড়ক মারধর করতে থাকেন তারা। এ সময় কিছু আন্দোলনকারী ভবনের বিভিন্ন গেট দিয়ে বের হয়ে মলচত্বর, মুহসীন হল ও সূর্যসেন হলের দিকে যান। সেখানেও ইট, রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের মারধর করা হয়। হামলার সময় রেজিস্ট্রার ভবনের দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের অনেকে ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গিয়ে অফিসকক্ষে আশ্রয় নেন। সেখানেও কয়েকজনকে মারধর করা হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে এ হামলা। মারধর শেষে বিকাল ৫টার দিকে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা মধুর ক্যান্টিনে চলে যান। হামলায় গুরুতর আহতরা হলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, ঢাবি শাখার সভাপতি তুহিনকান্তি দাস, মহানগরীর নেতা অনীক বিশ্বাস, ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার সভাপতি ইভা মজুমদার। এ ছাড়া আহতদের মধ্যে সালমান সিদ্দিক, আন্দোলনের সমন্বয়ক মাসুদ আল মাহদী, রাজীব, রিফাত, সুদীপ্ত, জিম, তাজওয়ার মাহমিদ সিয়াম, সাদিক, তমা, রাজীব, নওরীন, মাকসুদা ও জামিলের নাম জানা গেছে।

হামলায় দুই সাংবাদিকও আহত হন। তারা হলেন ইনডিপেনডেন্টের মীর আরশাদুল হক ও নিউ নেশনের অরণ্য আরিফ। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া আরও সাতজন সাংবাদিক মারধরের শিকার হন। তারা হলেন বিডিনিউজের তপনকান্তি, অবজারভারের আবদুল করিম, প্রতিদিনের সংবাদের মাজহারুল ইসলাম রবিন, জনতার মুনতাসির মাহমুদ, কালবেলার রিফাত শোভন, বাংলা ট্রিবিউনের সিরাজুল ইসলাম রুবেল ও যুগান্তরের ফিচার লেখক সাইফুল ইসলাম খান।

ছাত্রলীগের সংবাদ সম্মেলন : এদিকে হামলার পর সন্ধ্যায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ নেতারা জানান, সাত কলেজের আন্দোলনের নামে ছাত্রদল-ছাত্রশিবির ও বাম নেতারা ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। এর ফলস্বরূপ তারা উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করেন এবং অবরুদ্ধ করে রাখেন। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা খবর পেয়ে উপাচার্যকে উদ্ধার করেন। সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ঢাবি শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসানসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর