শনিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী - ১৪৭

আঁধারে মিশে ছিল ওরা

মির্জা মেহেদী তমাল

আঁধারে মিশে ছিল ওরা

ওরা তিনজন। রাতের আঁধারে মিশে আছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। এমন সময় ডালিম খবর নিয়ে এলো। সব রেডি থাক। জিয়াকে বাজারে  দেখা গেছে। তার সঙ্গে মোটরসাইকেল আছে। এই পথেই আসবে। ডালিমের এমন খবর শুনে মুহূর্তে প্রত্যেকে প্রস্তুত। ডালিম উত্তেজনায় কাঁপছে। চারজনের একজন বলল, ভাইজান, আপনে কাঁপাকাঁপি বন্ধ করেন। ঠাণ্ডা হয়ে বসেন। টেনশন নিয়েন না। আসতে দেরি, কাম শেষ হতে দেরি হবে না। একথা শুনে ডালিম আশ্বস্ত হয়। বলে, আমি জানি। তোরা ভালো কামলা। আমি টেনশন করছি না। ওই শালার আইজই শেষ দিন।”

মাটির রাস্তা। দুপাশে ছোট ছোট কলা গাছের ঝোপ। কিছুদূর পর পর বাড়িঘর। এমন একটা স্থানে ওই চারজন ঘাপটি মেরে আছে, দেখাই যাচ্ছে না। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় তারা। শিকারের আশায়। একজনকে পাঠানো হলো সামনের রাস্তার বাঁকের ওপর। ওই বাঁক থেকে সামনের পথটা  দেখা যায়। মোটরসাইকেলের হেডলাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাবে। কিছুক্ষণ পর বাঁক থেকে সংকেত পাওয়া যায়। একটা মোটরসাইকেলের হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। কোকিলের ডাকের মতো করে সংকেত দিল বাঁকের কাছে থাকা লোকটি। সে দৌড়ে চলে এসে অবস্থান নিল ঝোপের আড়ালে। সেখানটায় আগে থেকে গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়। মোটরসাইকেল এগিয়ে আসছে। আরও একটু এগিয়ে আসতেই মোটরসাইকেলের গতি কমে গেল। গাছের গুঁড়ির কারণে জিয়া তার মোটরসাইকেল থামিয়ে দেয়। কোন শালা গাছ কেটে রাখছেরে- জিয়ার এমন কথা ডালিমের কানে আসা মাত্র সে মোটরসাইকেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি। ডালিমকে দেখেই বলে, কী ব্যাপার তুই এখানে! ডালিমের জবাব, আমি একা না। আরও আছে।"তখনই আঁধারে মিশে থাকা চারজন প্রকাশ্যে আসে। কোনো কথা না বলেই তারা জিয়ার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালায়। রক্তাক্ত জিয়া লুটিয়ে পড়ে। আবারও কয়েক রাউন্ড গুলি জিয়ার শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। মৃত্যু নিশ্চিত করেই চারজন লাপাত্তা।

২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ঠিক এভাবেই খুন হন পুস্তক ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান। বাসার সামনে ঘাপটি মেরে থাকা অস্ত্রধারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। খবর শুনে বাসা থেকে ছুটে আসে তার স্ত্রী নাসিমা আর দুই সন্তান। স্বামীকে রক্তাক্ত অবস্থায়  দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নাসিমা। সাতকানিয়া থানায় নাসিমা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করে। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদ করে এলাকার  লোকজনকে। ফলাফল শূন্য। জিয়ার কোনো শত্রু থাকতে পারে কেউ তা বিশ্বাস করতে পারেনি। খুনিরাও ধরা পড়ে না। স্ত্রী নাসিমার কান্নাকাটির কারণে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে না পুলিশ। তদন্ত থমকে যায়। ঘটনার ৯ মাস পর গোয়েন্দারা সাতকানিয়া থেকে একজন ভাড়াটে খুনিকে গ্রেফতার করে। পুলিশের  জেরার মুখে ওই ভাড়াটে খুনি বলে দেয় জিয়া খুনের ঘটনাটি। পুলিশ ভাবে এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। ওই কিলারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পাকড়াও করে আরও তিন কিলারকে। তারা পুলিশকে যা বলে খুনের বিষয়ে, তা শুনে হতবাক পুলিশ। খুনিরা জানায়, এই ঘটনার সঙ্গে জিয়ার স্ত্রী নাসিমা এবং তার প্রেমিক জড়িত। ৬০ হাজার টাকায় তাদের ভাড়া করা হয় জিয়াকে খুন করতে। পুলিশ নড়েচড়ে বসে। গ্রেফতারের প্রস্তুতি নেয় তারা।

পুলিশের তদন্তে জানা যায়, পরকীয়ার জেরে সাতকানিয়ায় স্বামীকে ভাড়াটে গুণ্ডা ও খুনি দিয়ে খুন করান স্ত্রী নাসিমা আক্তার। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুই সন্তানের জননী নাসিমা আক্তার জানিয়েছিলেন,  মোবাইলে পরিচয় হয় ডালিম নামের এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রেম। স্বামী ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান জিয়া বিষয়টি জেনে যান এবং স্ত্রীকে ওই পথ থেকে ফিরে আসতে বলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রেমিক ডালিমকে নিয়ে স্বামীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নাসিমা। পেশাদার তিন খুনিকে ৬০ হাজার টাকায় ভাড়া করা হয়। ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি রাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ফেরার পথে ভাড়াটে খুনিরা জিয়ার  মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে তাকে গুলি করে হত্যা করে। স্বামী খুনের পর নাসিমা বাদী হয়ে থানায় মামলা করে। দীর্ঘ তদন্তে পুলিশ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে এবং স্ত্রী ধরা পড়ে। নাসিমা জানায়, স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কান্নাকাটি করেছি, যাতে পুলিশ বা অন্য কেউ সন্দেহ না করে। কিন্তু খুনিরা ধরা পড়ায় সব ফাঁস হয়ে যায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর