বৃহস্পতিবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

গ্রেফতার আতঙ্কে বিএনপি

কারাগারে গয়েশ্বর, শতাধিক আটক, বাড়িতে বাড়িতে অভিযান, খালেদার বাসায় অতিরিক্ত পুলিশ

মাহমুদ আজহার ও তুহিন হাওলাদার

গ্রেফতার আতঙ্কে এখন ঘরছাড়া অবস্থায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। ৮ ফেব্রুয়ারি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট’ মামলার রায়কে ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপিতে। গত রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ তিন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাকে আদালতে তোলা হলে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৫৫ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। গত রাতে মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলালসহ ছয় নেতা-কর্মীকে।

বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের মাঠপর্যায়ের প্রায় ২৭৫ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে। দলের আরেক প্রবীণ স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, দেশব্যাপী বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৭৮ হাজার ৩২৩। আর আসামির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৩ হাজার ২৩৮ জন। এ সরকারের সময়ে তাদের ৭৪৭ জন নেতা-কর্মী অপহূত হয়েছেন; সরাসরি ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন’ হয়েছেন ৫২০ জন; ১৫৭ জন এখনো নিখোঁজ। গত দুই দিনে নতুন করে চার মামলায় ৯০০ নেতা-কর্মীকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এরমধ্যে অজ্ঞাত আসামিই বেশি। ফলে গাঢাকা দিয়েছেন মধ্যসারি ও নিম্নস্তরের নেতা-কর্মীরা। অনেকেই বন্ধ রেখেছেন নিজের সেলফোন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার এড়িয়ে চলার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে ৮ ফেব্রুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে আদালত পাড়ায় নেতা-কর্মীদের অবস্থান নেওয়ারও অনুরোধ জানান তিনি। দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে তিনি শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের এই নির্দেশনা দেন। ঢাকাসহ সারা দেশের সাংগঠনিক ইউনিটগুলোতে একই বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার পরিকল্পিতভাবে বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার করছে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা ৮ ফেব্রুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে আদালতে যেতে চায়। কিন্তু সরকার সেটা মেনে নিতে পারছে না। উদ্দেশ্য একটাই, আগামী নির্বাচনকে একতরফা করা। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসনকে জেলে নিয়ে কিংবা সাজা দিয়েও বিএনপিকে দমাতে পারবে না। কোনো কারণে বেগম জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে সেই নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যও হবে না।’

গত মঙ্গলবার বকশীবাজারে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে ৯০০ নেতা-কর্মীকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে। যাদেরকে নতুনভাবে আটক করা হচ্ছে, তাদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, দলের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতসহ অন্যান্যদের ওই মামলায় আটক দেখানো হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, আটক হলে তাদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। পুলিশের ওপর আক্রমণের মামলার ধারাও জটিল বলে মনে করেন তারা। তাই গতকাল বিশেষ আদালতে খালেদা জিয়ার হাজিরা থাকলেও নেতা-কর্মীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, গত দুই দিনে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ছাড়াও গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপির সহ-গণশিক্ষা বিষয়ক সহসম্পাদক, ছাত্রদলের সহগণসংযোগ সম্পাদক আমজাদ হোসেন চৌধুরী শাহাদাত, যুব দলের সাবেক সহসম্পাদক গাজী হাবিব হাসান রিন্টু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা মহিলা দলের সভাপতি বেগম রাজিয়া আলিম, সাবেক যুবনেতা আবদুজ জব্বার, যুবদল নেতা মো. রুবেল, মো. হানিফ, দুলাল, মামুন আহম্মেদ, রাকিব আকন্দ, হোসনা, পারভিন, দিথি, লায়লা, জাকিয়া, মাহফুজুর রহমান চেয়ারম্যান, ফরিদ উদ্দিন জুয়েল, শাহ আলম, মাহবুব খান, সোকন মিয়া, মিন্নাত আলী, ইব্রাহিম, আমিনুর রহমান প্রমুখ। গতকালও বকশীবাজার থেকে কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। রাতে তল্লাশি চালানো হয়েছে নেতাদের বাসায় বাসায়।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে সরকার এক অশুভ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। গণগ্রেফতার সরকারের ভয়ঙ্কর অশুভ পরিকল্পনার অংশ। সরকার ভাবছে, গ্রেফতার করে দেশের মানুষ ও জাতীয়তাবাদী শক্তি ভয় পেয়ে যাবে, আতঙ্কগ্রস্ত হবে। এই গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা দেশ আরও বেশি ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়বে।’ সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার রাতে পুলিশি অভিযান চালায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানের বাসায়। গতকাল সকালে জিনজিরা যুব দলের সভাপতি মামুনের বাসায় পুলিশ তল্লাশি করে। এভাবে তল্লাশি ও আটকের ফলে দেশব্যাপী গ্রেফতার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। আটকের ঘটনার পর গতকাল অনেক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনও বন্ধ রেখেছেন অনেকে। বন্ধ পাওয়া গেছে বিএনপি নেতাদের পিএসদের নম্বরও। এদিকে কয়েক দিনের তুলনায় গতকাল সকাল থেকে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেও নেতা-কর্মীদের আনাগোনা কম ছিল। আর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আশপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। দুই দিন ধরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তাকে ছাড়াও গুটি কয়েক নেতা-কর্মীও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থাকছেন।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কারাগারে, ৫৫ নেতা-কর্মী রিমান্ডে : গ্রেফতারের পরদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে আনা হয়। তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। এ ছাড়া রাজধানীতে মিছিল থেকে পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও প্রিজন ভ্যানের তালা ভেঙে দুই কর্মীকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার পৃথক চার মামলায় বিএনপির ৫৫ জন নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসান এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে রমনা থানায় দায়ের হওয়া মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়নি। আইনজীবীরা জামিন আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন বলেই গয়েশ্বর চন্দ্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন ও সাবেক মন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের ছেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতকে তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। শাহবাগ ও রমনা থানায় দায়ের হওয়া পৃথক চার মামলার অন্য আসামিদের পক্ষে বিএনপির আইন সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়াসহ বিএনপিপন্থি চারজন আইনজীবী আদালতকে বলেন, পুলিশের ওপর বিএনপির নেতা-কর্মীরা হামলা চালাননি। বরং পুলিশ নিজের লোক দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। যাদের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে, তাদের কারও বিরুদ্ধেই সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি পুলিশ। বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা আদালতের কাছে দাবি করেন, আসামিদের মধ্যে কয়েকজন আছেন, যারা বৃদ্ধ। গতকালের হামলার ঘটনার সময় তাদের গ্রেফতার করা হয়নি। খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন থানা ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করছে। তারই অংশ হিসেবে দু-তিন দিন আগে এসব আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। পরে গতকাল এ ঘটনা ঘটিয়ে তাদের এই মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

অপর দিকে রাষ্ট্রপক্ষে সরকারি কৌঁসুলি সাজ্জাদুল হক আদালতে বলেন, আসামিরা পুলিশকে হত্যার উদ্দেশেই ইটপাটকেল ছুড়ে আক্রমণ করেছে। নাশকতা চালিয়েছে। কেন পুলিশের ওপর এই আক্রমণ এবং কোন নেতারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন— তা খুঁজে বের করার জন্য এই আসামিদের নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেয়। আদালত সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় শাহবাগ থানায় পৃথক দুই মামলায় ১৮ জনকে দুই দিন করে এবং রমনা থানায় দায়ের হওয়া মামলায় ৩৫ জনকে দুই দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেয় আদালত। সাবেক মন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্য ইসলামকে তিন দিন এবং কেন্দ্রীয় নেতা আনিসুর রহমানকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর