শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

একুশে ফেব্রুয়ারি সেকাল ও একাল

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

একুশে ফেব্রুয়ারি সেকাল ও একাল

একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগে এটি একটি তারিখ মাত্র ছিল, ক্যালেন্ডারের অন্যান্য তারিখের মতোই। কারও জন্মদিন। কারও বিবাহবার্ষিকী। কখনো বা ছুটির দিন বা অন্য কোনো কারণে ক্যালেন্ডারে চিহ্নিত। ১৯৫২ সালে এসে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আর তারিখ রইল না। সবকিছু ছাড়িয়ে হয়ে উঠল এক মূর্তপ্রতীক। অনেকজন অনেক ভাবে এর প্রতীকী অর্থ প্রকাশ করেছেন। একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে মায়ের ভাষা। একুশ মানে রক্তবীজ। একুশ মানে ভালোবাসা। একুশ মানে স্বাধীনতা। একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তবীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালি জাতির বোধিবৃক্ষ। ঘুমন্ত বাঙালি জেগে উঠেছিল। আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছিল। মোগল-পাঠান-ইংরেজ আর পাকিস্তানি শাসনের শোষণভাঙার প্রত্যয়ে দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করেছিল। বায়ান্নর পরিণতিই একাত্তর। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত একুশে পালন করত বাংলার গণমানুষ। সরকার কখনো বাধাদানকারী, কখনো নীরব দর্শক। কোনো আইন পাস হয়নি, সরকারি নির্দেশ জারি হয়নি, বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়নি। বোধিবৃক্ষের অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে বাংলার গ্রামেগঞ্জে রাতারাতি গড়ে উঠেছিল অসংখ্য শহীদ মিনার। একুশ মানে স্বাধীনতা। আর একুশের প্রতীক হলো শহীদ মিনার। তাই একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাতে হানাদার বাহিনী শহীদ মিনার আক্রমণ করেছিল। নিষ্প্রাণ ইট-সুরকিতে তৈরি শহীদ মিনারে প্রতিফলিত হয়েছিল বাঙালি জাতির প্রাণ।

১৯৬২ সালের একটি ছোট্ট ঘটনা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শিক্ষা আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনেরও শক্তি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ছাত্ররা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে অনুরোধ করেছিল, একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই যেন সব সাইনবোর্ড বাংলায় রূপান্তর করা হয়। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র ছিল না, লাঠি ছিল না। আবেদনের ভাষায় হুমকি ছিল না। ভালোবাসা ছিল। ম্যাজিক ঘটে গেল। অল্প কয়েকটি দোকান ছাড়া সব দোকানপাটে বাংলা সাইনবোর্ড লাগানো হলো। একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্ররা নিজেদের পয়সায় আলকাতরা কিনে ভিন্ন ভাষায় লেখা সাইনবোর্ডগুলোয় আলকাতরা মাখিয়ে দিল। কাউকে ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। আজ দেশে পাকিস্তানি নেই। শাসনেও বাঙালি। শোষণেও বাঙালি। তোষণেও বাঙালি। আমি কিন্তু আজ আর সেদিনের একুশকে প্রত্যক্ষ করছি না। ঢাকার রাস্তার দুই পাশের সাইনবোর্ডগুলো অধিকাংশই বিজাতীয় ভাষায়। এমনকি বাংলা নামটিও ইংরেজি অক্ষরে লেখা। কথাবার্তায় ইংরেজির মিশেল না দিলে তো অভিজাত হওয়া যায় না। সংগ্রামের বাঙালি কি বিজয়ের শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে? একুশের বোধিবৃক্ষ কি মরে গেছে? অনেকেই বলেন, বিশ্বায়নের কালো ছায়ায় বাঙালি নাকি স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। জাপানি ও কোরিয়ানরা আগে ইংরেজি শিখত না। এখন ব্যবসার জন্য অনেকে শেখে। কিন্তু নিজেদের মধ্যকার কথাবার্তায় ইংরেজি বলে না। এমনকি রেস্তোরাঁর গ্রাহকদের সঙ্গেও ইংরেজি বলে না। জেনেও না জানার ভান করে। তারা জাতীয়তা সংহত করেছে। আমরা অর্জনের পর বিসর্জন দিচ্ছি। কিন্তু কেন?

শহীদ মিনারকে বলেছিলাম বায়ান্নর বাংলা ভাষার প্রতীক। একাত্তরে এসে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতির হিমালয়সম প্রতীক। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে হত্যা করা হয়েছিল। বাঙালিত্বকে হত্যা করা হয়েছিল। কিছুসংখ্যক নাদান বানর প্রকৃতির বাঙালি এখন অযাচিত ভুল ইংরেজি বলে ‘জাতে’ উঠতে চায়। ডালভাত খাবার ভাঙাচোরা রেস্তোরাঁয় ইংরেজিতে ‘ফাইভ স্টার হোটেল’ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে তৃপ্তি বোধ করে। গ্রাহকরা সাইনবোর্ডটি পড়তেও পারে না। বরং ইংরেজি লেখার একপাশে একটি মুরগি ও অন্য পাশে একটি খাসি বা গরু আঁকা দেখে বুঝতে পারে এটা হোটেল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের দেশ বলে গর্ব করা হলেও চিত্তের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। বিত্ত কখনো চিত্তে অবস্থান করে না। চিত্তে থাকে ভালোবাসা। মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। বাঙালির চিত্তে অবস্থান গ্রহণ করে চিত্তকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে হত্যার মাধ্যমে চিত্ত হত্যা করে আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি তথা বিত্তের পেছনে কুকুরের মতো ঘুরছি। বিত্ত আহরণে দোষ নেই। কিন্তু বিত্ত নিয়ে অহংকার চিত্তের বোধিবৃক্ষকে হত্যা করে ফেলেছে। পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। বায়ান্নর আত্মোপলব্ধির বৃক্ষকে জলসিঞ্চন করতে হবে। একাত্তরের আত্মপ্রত্যয় এবং অর্জনকে আবার হৃদয়ে স্থাপন করতে হবে। আমার মতো বায়ান্নদর্শীদের এটাই আশাহত বিলাপ।

সর্বশেষ খবর